কারাবন্দীদের চিকিৎসা

দেশের ৬৮টি কারাগার ও ১টি ২০০ শয্যা হাসপাতালের জন্য ১৪১ জন চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ থাকলেও সেখানে কর্মরত আছেন মাত্র ৯ জন। বাকি পদগুলো বছরের পর বছর শূন্য আছে। গত ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কারাগারে ৪০ হাজার ৬৬৪ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দী রয়েছেন ৮৯ হাজার ৯১০ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০ হাজার বন্দীর জন্য ১ জন চিকিৎসক। এই ৯ জন চিকিৎসকের পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক কারাবন্দীর চিকিৎসা যে সম্ভব নয়, সে কথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অজানা নয়।

কারাগারে চিকিৎসক–সংকট নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিকবার খবর প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বরাবর নির্বিকার থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে দ্বৈত শাসন বলে একটি বিষয় চালু ছিল। ব্রিটিশরা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। এরপর পাকিস্তান আমল গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশও ৪৮ বছর পার করেছে। কিন্তু দ্বৈত শাসনের যে অবসান ঘটেনি, কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারাবিধি অনুযায়ী, কারা কর্তৃপক্ষ কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দিতে পারে না। কারাগারের বন্দীদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক প্রয়োজন হলে কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা শাখায় তাদের চাহিদার কথা জানাবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লিখবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নিলেই কেবল কারাগার কর্তৃপক্ষ চাহিদামাফিক চিকিৎসক পাবে। অন্যথায় কারাবন্দীদের অসুখ যত গুরুতরই হোক না কেন, তাঁরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিতই থাকবেন।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে কারাগারে চিকিৎসক–সংকটের বিষয়টি শুধু দুই মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালি কিংবা গণমাধ্যমের খবরের মধ্যে সীমিত থাকেনি। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর্যুপরি তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কারাগারের জন্য ২০ জন চিকিৎসককে পদায়ন করেছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র চারজন যোগ দিয়েছেন। অন্যরা নানা অজুহাতে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যোগদান না করা চিকিৎসকদের কেউ কেউ শিক্ষা ছুটিতে আছেন। তাহলে কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি জেনেশুনেই তঁাদের পদায়ন করেছে?

কেন ১৬ জন চিকিৎসক যোগদান করেননি, হাইকোর্টের এই কারণ দর্শানোর জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। জানা থাকলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই জবাবে হতবাক হয়েছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সঠিক তথ্য আদালতকে দেয়নি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে মোট ২৪টি চিঠি পাঠিয়ে চিকিৎসক পদায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কেন বিষয়টি অস্বীকার করা হলো, তা–ও জানতে চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এই অসত্য ভাষণ ও কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে উদাসীনতা অমার্জনীয় বলে মনে করি। উচ্চ আদালত কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ২৭ জানুয়ারির মধ্যে তা জানাতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।

কারাগারের বাইরে কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে তঁার চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু যাঁরা কারাবন্দী, তাঁদের সেই সুযোগটি নেই। চিকিৎসার বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের ওপরই নির্ভর করে। চিকিৎসার অভাবে কারাগারে বন্দীদের শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হওয়া; এমনকি মৃত্যুর খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। কারাবন্দী ব্যক্তি হাজতি বা দণ্ডপ্রাপ্ত যে–ই হোন না কেন, তাঁকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তিনি অপরাধী হলেও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার তাঁর আছে।

প্রয়োজনে কারা কর্তৃপক্ষের হাতেই কারাগারের ভেতরে চিকিৎসক নিয়োগের কর্তৃত্ব দেওয়া হোক। দ্বৈত শাসনের চেয়ে সেটাই হবে উত্তম।