যৌনপল্লির শিশুদের জন্য বই

উপনিবেশ আমলে শাসন-শোষণ পোক্ত করার মানসে বহু ‘যত্নে’ জনতার সঙ্গে পুলিশের ফারাক লালন করা হতো। দীর্ঘকালের ভীতিসঞ্চারী চর্চার মধ্য দিয়ে পুলিশ নিজেকে আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তার রেশ এখনো হয়তো আছে। সে কারণেই পেটানো, হেনস্তা করা, গালাগালি করা—এগুলোকে অধিকাংশ মানুষ পুলিশি কাজের স্বাভাবিক ধারা মনে করে।

আনন্দের কথা, এই ধারণা বদলাতে শুরু করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা এখন অনেক জনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বেদে, হিজড়া, পথশিশুর মতো সমাজের একেবারে তলানিতে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের পুনর্বাসনে কাজ করছেন। নতুন বছরে বাংলাদেশ পুলিশের স্লোগান ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার।’ জনতার কাছে, বিশেষত একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের স্বেচ্ছাসেবকের মতো উপস্থাপন করার প্রয়াস চালাচ্ছে তারা।

এই প্রয়াসের সর্বশেষ নজির স্থাপন করেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থানার পুলিশ। তারা বুধবার দৌলতদিয়ার যৌনপল্লির সুবিধাবঞ্চিত দুই শ শিশু-কিশোরের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছে। দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন মুক্তি মহিলা সমিতির (এমএমএস) মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তা ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান শিশু-কিশোরদের হাতে স্কুলব্যাগ, খাতা-বই-কলম, টিফিন বক্স, দুধের ফিডারসহ নানা ধরনের উপকরণ তুলে দেন।

যৌনপল্লিতে মানবেতর জীবন যাপন করা যৌনকর্মীরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের জেলেদের মতোই ‘গরিবের মধ্যেও গরিব, ছোটলোকের মধ্যেও ছোটলোক’। দুঃসহ দারিদ্র্য ও চরম সামাজিক অবমাননার শিকার হওয়া এই নারীরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও অভাবের কারণে এসব শিশু শিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে পারে না। সমাজ-সংসার দূর দূর করে তাদের ঠেলে দেয়। চিরকালীন দুঃখের তিমিরই হয় তাদের শেষ ঠিকানা।

এই শিশুদের বিষয়ে হাবিবুর রহমানের বক্তব্য, ‘আজ অনুভব করলাম: এখানকার একেকজন নারী যেন একেকটি উপন্যাস। তাঁদের নিষ্পাপ শিশুগুলো একেকটি অপার সম্ভাবনা। একজনকে কোলে নিলাম, কি নিষ্পাপ চাহনি! ... আমিও তো এদের কেউ হতে পারতাম! ...যৌনকর্মীদের সন্তানদের পড়াশোনা ও যথার্থ মানুষ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার আপনার সবার। শুধু যৌনকর্মী বা তাঁদের সন্তানেরাই নয়, এই সমাজে যারা তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া হিসেবে পরিচিত, তাদেরও পুনর্বাসন করতে হবে। বেদে সম্প্রদায়কে নিয়েও ভাবতে হবে।’

এটি গোটা পুলিশ বাহিনীর সামগ্রিক উপলব্ধি হয়ে উঠলেই পুলিশ ‘অনুভূতিহীন’ নয়, বরং ‘অনুভূতিশীল’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠা পাবে। পুলিশ যে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনী নয়, বরং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবামূলক বহু কাজেও যে তারা অবদান রাখতে পারে, তা মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে তাকেই প্রমাণ করতে হবে।