নিজেকে নিয়ে কৌতুক

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রিডার্স ডাইজেস্ট জানুয়ারি ২০২০-এর এশিয়া সংস্করণ হাতে নিয়ে বসে আছি। আর্থার গর্ডন নামের একজন লেখক একটা লেখা লিখেছেন, নিজেকে নিয়ে কীভাবে পরিহাস করা যায়।

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে পারাই নাকি শ্রেষ্ঠ রসিকতা!

আর্থার গর্ডন লিখেছেন, এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পৃথিবীর সেরা মানুষ কে? একেকজন একেক মহামানবের নাম বলেছিলেন। একজন সুন্দরী উত্তর দিয়েছিলেন, বব হোপ। কারণ, বব হোপ নিজেকে নিয়ে হাসি-মশকরা করে সারা পৃথিবীকে হাসান।

বব হোপ একজন কৌতুকবিদ ছিলেন।

তাঁর তিনটা কৌতুক আগে পরিবেশন করে নিই।

‘আমি কীভাবে নাচ শিখলাম। আমরা ছিলাম ছয় ভাই। বাথরুম ছিল একটা। বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমি নাচ শিখে ফেলেছি।’

‘ডেমোক্র্যাটরা জানে কীভাবে বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে। তারা সবাই প্রেসিডেন্ট পদে ইলেকশন করতে চাচ্ছে।’

‘আমি কখনো টের পাই না যে আমার বয়স হয়েছে। বেলা দুটোর আগে পর্যন্ত আমার কোনো অনুভূতি কাজ করে না, তারপর আমি ঘুমাতে যাই।’

ওয়ারেন ছিলেন আমেরিকার প্রধান বিচারপতি। তিনি একটা গল্প বলেছিলেন। তিনি যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটর্নি, তখন একবার তাঁকে বক্তৃতার জন্য ডাকা হয়। বক্তা ছিলেন অনেক। শ্রোতাও ছিলেন ঘর ভরা। বক্তারা বলবেন নামের আদ্যক্ষর অনুসারে। একে একে বক্তারা ভাষণ দিচ্ছেন, তারপর চলে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের সমর্থকেরাও চলে গেলেন। ওয়ারেনের নাম শুরু হয়েছে ডব্লিউ দিয়ে। কাজেই তিনি ছিলেন শেষ বক্তা। তিনি যখন বক্তৃতা শুরু করেন, তখন সামনে মাত্র একজন শ্রোতা। তিনি ভাষণ শেষ করে শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানাতে গেলেন। শ্রোতা বললেন, ‘আমি আপনার ভাষণ শুনতে দাঁড়িয়ে নেই, আমার নাম ইয়াং। আমি শেষ বক্তা।’

সৈয়দ মুজতবা আলীও নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে পারতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একাধারে producer এবং consumer—তামাকের মিকশ্চার দিয়ে আমি নিজেই সিগারেট বানিয়ে producer এবং সেইটে খেয়ে নিজেই consumer: আরও বুঝিয়ে বলতে হবে? আমি একখানা বই produce করেছি।—কেউ কেনে না বলে আমিই consumer, অর্থাৎ নিজেই মাঝে মাঝে কিনি।’

আমারও সেই অবস্থা। সেই গল্পটা ফেসবুকে লিখেছিলাম। এখানে আরেকবার বলি। শুধু তার আগে বলে রাখি, সংস্করণ কথাটার অর্থ পরিমার্জন। ঘষামাজা করা।

আমার বই বিক্রি হয় না। তা নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেইন নেই। কিন্তু আমি বই বিক্রি করতে দিলাম ১৫০, অবিক্রীত ২০০ কপি ফেরত এল কেন, এইটা নিয়ে আমি ধন্দে পড়ে গেলাম।

আমার বই ছাপা হলো। আমি দেড় শ কপি বই বিভিন্ন দোকানে আর স্টলে রাখতে দিলাম। বললাম, ভাই, টাকা লাগবে না। যদি বিক্রি হয়, কিছু দিয়েন।

ছয় মাস পর দোকানিরা ফোন করেন, ভাই, আপনার বই বিক্রি হয় না। ফেরত নিয়ে যান। আমাদের গোডাউনে জায়গা নেই। ফেরত না নিলে ফেলে দেব।

আমি ভাবলাম, নিজে টাকা দিয়ে লোক পাঠিয়ে ৩০ কপি কিনিয়েছি। সেই ৩০ কপির দাম তো পাওয়া যাবে।

বই ফেরত আনতে গেলাম। দিয়েছিলাম ১৫০, ফেরত এল ২০০।

কীভাবে সম্ভব। আরে আমি নিজেই তো কিনে নিয়েছি ৩০ কপি।

এ কী ভুতুড়ে কাণ্ড!

অনেক পরে জানতে পেরেছি আসল ঘটনা!

আমি দিয়েছি ১৫০ কপি। আর বাইন্ডাররা চুরি করে দিয়েছে ৮০ কপি। ৩০ কপি আমি কিনেছি। এক কপিও বিক্রি হয়নি। তাই ২০০ কপি ফেরত এসেছে।

দোকানিরা বললেন, আপনি দিয়েছেন যত কপি, ফেরত পাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি, সেগুলোর দাম দিতে হবে।

আমাকে আরও ৫০ কপির দাম নিজের পকেট থেকে দিতে হলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

এখন এই ২০০ কপি বই নিয়ে আমি কী করব?

বইয়ের দাম ছিল ১৫০ টাকা। পট্টি মেরে দাম বাড়িয়ে করলাম ৫০০ টাকা।

আরেকটা পট্টি মেরে লাগিয়ে দিলাম দ্বিতীয় সংস্করণ।

তারপর বন্ধু আর আত্মীয়স্বজনের জন্মদিনে, বিয়েতে বই গিফট করা শুরু করলাম।

এতে উপকার পেলাম।

এখন আর কেউ আমাকে দাওয়াত দেয় না।

আমার অনেক অবসর। অবসর সময়ে আমি বই লিখি।

আমার লেখক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কী করো?

বই লিখি।

কী বই লেখো?

পঞ্চম সংস্করণ লিখি।

মানে কী?

আমার বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ লিখছি। এখন কথা বলতে পারব না। খুব বিজি।

আমার ওই বইটাই আবার লিখছি। পাঁচবার কারেকশন করব। তাহলেই পঞ্চম সংস্করণ হয়ে যাবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক