শুদ্ধি অভিযানের গতি ও পরিণতি

সরকারের বছরপূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছে, গত এক বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে ও বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা কমেছে। সংস্থাটির কয়েক বছরের ধারাবাহিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ থাকলেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ে আর বিরোধী দল রাস্তায় নামতে না পারলেও। এটি একটি ধাঁধাও বটে। 

জনপ্রিয়তা বাড়া বা কমার পাশাপাশি আইআরআইয়ের জরিপে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে—দুর্নীতি ও বৈষম্য। ৭৬ শতাংশ মানুষ মনে করে, বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। ৩১ শতাংশ জানিয়েছে, দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনে। ১৯ শতাংশ দুর্নীতিকেই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। টিআইবির খানা জরিপ বলছে, ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়। 

বৈষম্য ও দুর্নীতি অর্থনীতির দুটি আলাদা সূচক হলেও এর মধ্যে একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। যেসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা বেশি, সেসব দেশে বৈষম্য প্রকট। উদাহরণ হিসেবে সোমালিয়া, ইয়েমেন ও উত্তর কোরিয়ার কথা বলা যায়। আবার যেসব দেশে দুর্নীতি কম, সেসব দেশে বৈষম্যও কম। যেমন নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে বাংলাদেশও বিএনপির আমলে চারবার ও আওয়ামী লীগ আমলে একবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রসারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু সরকার তখন আমলে নেয়নি। দুর্নীতির সব দায় পূর্বসূরি বিএনপির ওপর চাপিয়ে নিজেদের শুদ্ধতা প্রমাণের চেষ্টা করে আসছিল। দেরিতে হলেও গত সেপ্টেম্বরে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, যাকে রাজনীতির ভাষায় শুদ্ধি অভিযান হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এই অভিযানে যাঁরা ধরা পড়েছেন, যাঁদের নামে মামলা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী। আবার এমন ব্যবসায়ী-ঠিকাদারও ধরা পড়েছেন, যাঁরা বিএনপির আমলে বিএনপির নেতাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাদের আস্থাভাজন। ক্ষমতা বদলায়, চরিত্র বদলায় না। 

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকারের শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। একই দিনে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চলে। ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর নিয়ন্ত্রক ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তাঁর সহযোগী হিসেবে নাম আসে সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম ওরফে সোহেল প্রমুখের। ক্যাসিনো ব্যবসার বাইরে ঠিকাদারি থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক জি কে শামীম গ্রেপ্তার হন। একই সময়ে সূত্রাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও অর্থ উদ্ধার করলেও তাঁদের ধরতে পারেনি। তাঁরা ধরা পড়েছেন অতিসম্প্রতি। 

সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ সরকারের শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের যেসব পোড় খাওয়া নেতা অনুপ্রবেশকারী ও সুযোগসন্ধানীদের কনুইয়ের গুঁতোয় টিকতে পারছিলেন না, তাঁরাও মনেপ্রাণে চাইছিলেন এ রকম একটি অভিযান চলুক। তাঁদের কেউ কেউ এ–ও বলেছেন, দুর্নীতি নিয়ে কাগজগুলোর উচিত বেশি বেশি রিপোর্ট করা। তাতে নব্য আওয়ামী লীগারদের দৌরাত্ম্য যেমন কমবে, তেমনি দেশও লাভবান হবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত একাধিকবার বলেছেন, দুর্নীতি না হলে প্রবৃদ্ধি আরও ২ শতাংশ বেশি হতো। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। খেলাপি ঋণ কমাতে পারেননি। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পারবেন কি? 

 ৭ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আহ্বান থাকবে, যে–ই অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। সাধারণ মানুষের হক যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে ৩০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘এটা করতে হবে এই জন্য, আমরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। উন্নয়নের জন্য আমরা প্রকল্প তৈরি করছি। অর্থ বরাদ্দ করছি। কাজ হচ্ছে। আমরা চাই তার প্রতিটি পাই পয়সা যেন যথাযথভাবে ব্যবহার হয়, যথাযথভাবে খরচ হয়। আর সেখানে যদি কোনো অনিয়ম হয়, উন্নয়ন তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান দুদক কতটা আমলে নিচ্ছে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশাসন কতটা সক্রিয় হয়েছে? সাম্প্রতিক কালে দুদক কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-মেয়রের এপিএসকেও তলব করেছে তারা। কারও কারও বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। কিন্তু মামলা করাই যথেষ্ট নয়, আগে শর্ষের ভেতরের ভূত তাড়াতে হবে। যাঁরা দুর্নীতি করেন আর যাঁরা দুর্নীতি ধরেন, তাঁদের মধ্যে বহু বছর ধরে একটা আঁতাত গড়ে উঠেছে। ডিআইজি মিজান ও দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরই এর একমাত্র উদাহরণ নন। নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমকে যাঁরা ব্যাংকের ঋণখেলাপি বানান, তাঁরা কীভাবে দুর্নীতি দমন করবেন? 

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম দুদক তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালনে সচেষ্ট হলো। তারা নিরপরাধ জাহালমদের মামলায় না ফাঁসিয়ে সত্যিকার অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দিল। তারপরও নিশ্চয়তা নেই অপরাধীরা দ্রুত সাজা পাবেন। একটি উদাহরণ দিই। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসেনসহ ডেসটিনি গ্রুপের ২২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুদক। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ (এমএলএম) ও ট্রি-প্ল্যান্টেশন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থের মধ্যে ৩ হাজার ২৮৫ কোটি ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫২৪ টাকা আত্মসাৎ করে পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই মামলা হয়। এখনো মামলা দুটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। বিলম্বিত বিচার—বিচার না হওয়ারই শামিল। 

দুর্নীতি দমনে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন আছে। মাঝেমধ্যে এ ধরনের অভিযান হলে দুর্নীতিবাজেরা কিছুটা হলেও খামোশ হবে। ভয় পাবে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্নীতির বিপরীতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আইনের শাসনের ওপর; সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ওপর। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি দুর্নীতির ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা জরুরি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চালিত অভিযানে আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে ধরা ও কাউকে ছাড় দেওয়ার নীতি পরিহার করতে হবে। 

যেসব দেশ দুর্নীতি দমনে সফল হয়েছে, সেসব দেশ পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতি কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। একসময় দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। দুটি দেশই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতন্ত্রায়ণের অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। সেই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে তারা নাগরিক সমাজ, ছাত্র-তরুণ ও গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করেছে। 

পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতির রাশ এমনভাবে টেনে ধরতে হবে, যাতে শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিতে না পারে, ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে না পারে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনার নামে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে বালিশ কেনার নামে পুকুরচুরি করতে না পারে, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এত অভিযানের পরও দিনাজপুরের পার্বতীপুরে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা প্রমাণ করে যে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। 

শুদ্ধি অভিযান নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন আছে। আশাও আছে। যেমন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান গত ১২ অক্টোবর রাজধানীর এফডিসি মিলনায়তনে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বর্তমান শুদ্ধি অভিযান’ শীর্ষক বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এই অভিযান কেন আরও আগে শুরু হলো না? আর হঠাৎ করেই–বা কেন শুরু হলো তার ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মনে আশা জাগিয়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে, এই অভিযান সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পরিণত হলেই শুধু সফলতা আসবে।’ 

দেশের মানুষ শুদ্ধি অভিযানের সফলতাই দেখতে চায়, ব্যর্থতা নয়। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]