শিশুজীবন রক্ষার জাদুকরি সমাধান

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২০১৯ সালের বিশেষ ১০টি বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের অন্যতম কৃতিত্ব এসেছে বাংলাদেশের পুষ্টিবিজ্ঞানীদের হাত ধরে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সম্প্রদায় এই স্বীকৃতি দিয়েছে যে খাবার স্যালাইনের পর আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা আরও একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। ‘শিশুখাদ্য গবেষণায় অনন্য অর্জন’ শিরোনামে এ নিয়ে ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ও আমাদের গৌরব করার মতো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয়। এ উদ্ভাবনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতটা, প্রতিবেদনটি থেকে তা হয়তো পুরো উপলব্ধি করা যাবে না।

আমাদের মনে এমন কৌতূহল জাগবে যে কী এমন সেই উদ্ভাবন যে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স জার্নাল সেটিকে বিশ্বে গত বছরের সেরা গবেষণার প্রথম ১০টির সারিতে ঠাঁই করে দিল? এ গবেষণার ফলাফল কী এমন ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে এ দেশের শিশুখাদ্য ও পুষ্টি অবস্থার পটপরিবর্তনে?

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, তেমন সমস্যার একেবারে সামনের দিকে আছে শিশু অপুষ্টি। অপুষ্ট মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া বেশির ভাগ শিশুও হয় অপুষ্ট। এরপর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, অসচেতনতা—এসব বিষয় অপুষ্ট শিশুর স্বাস্থ্যকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্ট শিশুদের পরিপাকতন্ত্র সুগঠিত না হওয়ায় তাদের শরীরে খাবারের পুষ্টি পূর্ণমাত্রায় শোষিত হয় না। এর ফল খর্বত্বের মতো নিয়তি। দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশু হঠাৎ অসুস্থ হলে কিংবা প্রাকৃতিক বা মানবিক দুর্যোগে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে তারা অপুষ্টির একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়। খর্বকায় এসব শিশু তখন পড়ে শোচনীয়তম অপুষ্টির কবলে। পুষ্টিবিজ্ঞান যাকে বলে কৃশকায়ত্ব। কৃশকায় শিশুরা থাকে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে। বেঁচে গেলেও শারীরিক ও মানসিক রুগ্‌ণতার কারণে তাদের পরবর্তী জীবনের সব সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। দেশের সম্পদ হয়ে ওঠার বদলে তারা হয়ে ওঠে দুর্বহ বোঝা। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে প্রতি ১০ জনের একজন শিশু এ ভয়াবহ অবস্থার শিকার।

এ ধরনের অপুষ্টি প্রতিকারের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্বব্যাপী চিকিৎসার সুপারিশ দুই ধারার। প্রথমত, কৃশকায় শিশুর ডায়রিয়া বা অন্য কোনো রোগজনিত জটিলতা থাকলে তার জন্য দরকার পড়ে হাসপাতালের চিকিৎসার। তাদের ক্ষেত্রে এ চিকিৎসার মেয়াদ বেশ দীর্ঘ। অপুষ্টি থেকে তাদের বের করে আনতে গড়ে সময় লেগে যায় তিন থেকে চার সপ্তাহ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পরিবারের পক্ষে এত দিন ধরে হাসপাতালে রেখে শিশুর চিকিৎসা করানো কেবল কঠিন নয়, দুঃসাধ্যও হয়ে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে কৃশকায় শিশু যাতে চিকিৎসাসেবার ফাঁক গলে পড়ে না যায়, সে উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনে পৃথিবীর নানা দেশ দ্বিতীয় আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ বিকল্পে অপুষ্টির শেষতম প্রান্তে পৌঁছানো শিশুকে নিজের ঘরে রেখেই পরিবার তাকে অপুষ্টি থেকে বের করে আনতে পারে। এ ব্যবস্থায় দুধ, বাদাম, তেল, চিনি আর ভিটামিন ও মিনারেলের মিশ্রণে তৈরি বিশেষ এক ধরনের পুষ্টিপথ্য শিশুকে বাড়িতে রেখেই খাওয়ানো সম্ভব। প্যাকেটজাত সে পথ্যে ক্যালরির মাত্রা অতি উচ্চ। এ পথ্য স্বল্পতম সময়ে শিশুর অপুষ্টি দূর করে। বিদেশ থেকে আমদানি করা এই প্যাকেটজাত পথ্যেই এত দিন ধরে নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো কাছের দেশগুলোয় এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নানা দেশে অপুষ্ট শিশুর চিকিৎসা হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের অপুষ্টির চিকিৎসায় প্যাকেটজাত এ পথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও আমাদের দেশের শিশুদের জন্য এখন পর্যন্ত এটি অনুমোদিত হয়নি। বাংলাদেশের শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে বিশ্বস্বীকৃত এই প্যাকেটজাত পথ্য ব্যবহারের অনুমোদন এখনো কেন দেওয়া হয়নি তার উত্তরটি সহজ; পথ্যটির আমদানি ব্যয়বহুল। তবে এর চেয়েও বড় কারণ সম্ভবত এই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে দেশের দুই ধারার পুষ্টিবিদদের মতবিরোধ।

ব্যয়বহুল হলেও এক ধারার পুষ্টিবিদ অপুষ্টি চিকিৎসায় এ পথ্যটিকে এখনো মন্দের ভালো বলে মনে করছেন। কারণ, বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে দীর্ঘদিন হাসপাতালে রেখে শিশুর কৃশকায়ত্বের চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। সব উপজেলা হাসপাতালে এ চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই। আবার দেশে তৈরি কোনো পুষ্টিপথ্যও হাতে নেই। সারা দেশে এমন অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এরা কি তাহলে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষিতই হয়ে যাবে? দেশে বিকল্প পুষ্টিপথ্য তৈরির আগ পর্যন্ত আমদানি করা প্যাকেটজাত পথ্যে আগে শিশুদের জীবন রক্ষার পক্ষে এই ধারার পুষ্টিবিদেরা।

অন্য ধারার পুষ্টিবিদেরা মনে করেন, আমদানি করা এই পুষ্টিপথ্য অপুষ্টি পুরোপুরি নির্মূল করে না, সাময়িকভাবে সারিয়ে তোলে। তাদের অনুমান, প্যাকেটজাত এ পথ্যে এমন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যা পরে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াবে। তাদের আরেক উদ্বেগ, প্যাকেটজাত
পথ্যে শিশুর খাদ্যরুচি পাল্টে গেলে এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ঘরের খাবারে পরে তার রুচি ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।

দুই ধারার পুষ্টিবিদের কাছেই নিজের মতো করে যুক্তি আছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বিতর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মুশকিল হলো তঁাদের এই বিতর্কের ফাঁক দিয়ে বহু শিশুর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। তারা নিরাময়-অযোগ্য শারীরিক-মানসিক রুগ্‌ণতার মধ্যে চিরকালের জন্য নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে।

এই বিতর্ক যখন মধ্যগগনে, তখনই দেশি সমাধান নিয়ে হাজির হলেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। তাঁদের নতুন এ পুষ্টিপথ্য দেশি উপাদানে, অর্থাৎ ছোলা, কলা, সয়া আর বাদামের মিশ্রণে তৈরি। তাঁদের গবেষণা বলছে, এ পথ্য শিশুর অপুষ্টি দূর করতে সাহায্য করবে। তা ছাড়া এটি অন্ত্রে এমন এক ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করবে, যাতে শিশুর শরীর সহজে পুষ্টি শোষণ করতে পারবে। দেশি উপাদানে তৈরি বলে শিশুর খাদ্যরুচি পরিবর্তন নিয়ে পুষ্টিবিদদের শঙ্কাও এতে দূর হলো।

এ উদ্ভাবনে সবচেয়ে বড় সমাধানটি এসেছে পথ্যটির ব্যয়ভার কমায়। ধারণা করা হচ্ছে, দুধের বদলে সয়াবিন ব্যবহার করায় এতে অপুষ্টির চিকিত্সাব্যয় নেমে আসবে প্রায় অর্ধেকে। বাংলাদেশের শিশুরা তো এর প্রত্যক্ষ উপকার পাবেই। খরচ বেশ কম বলে বিশ্বজুড়ে সব অপুষ্ট শিশুই এর উপকার পাবে, অপুষ্টিসেবার আওতা পৃথিবীব্যাপী বহুগুণ বেড়ে যাবে।

অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পৃথিবীকে সহজলভ্য একটি হাতিয়ার উপহার দিয়েছেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। দেশের জন্য তাঁরা অনন্য গৌরব বয়ে এনেছেন। তাঁদের অভিনন্দন।

আসফিয়া আজিম: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী