সির সফর, চীনা মুকুট ও রাখাইন রত্ন

রোহিঙ্গা সমস্যা সত্ত্বেও চীন ও মিয়ানমার একসঙ্গে চলবে।  ছবি: এএফপি
রোহিঙ্গা সমস্যা সত্ত্বেও চীন ও মিয়ানমার একসঙ্গে চলবে। ছবি: এএফপি

যখনই মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মদদ চাই, চীন তখনই হাজির। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সম্পর্কটাও তেমনই। রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় হেগের আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ আসবে ২৩ জানুয়ারি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তখন থাকলেন (১৭-১৮ জানুয়ারি) মিয়ানমারের পাশে। ১০ বছর আগে যখন মিয়ানমার আরও একঘরে, তখনো চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সি মিয়ানমারের সেনাশাসকদের ‘উন্নয়নে’ আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

চীন আন্তর্জাতিক আঙিনায় মিয়ানমারের ঢাল হওয়ার বিনিময়ে কী চায়? চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর ভাষায়, ‘অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে মিয়ানমারের রাজনীতি বিষয়ে চীন হাত গুটিয়ে থাকবে।’ যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে চীন। চীনা ভূখণ্ডের সঙ্গে সড়ক, রেল ও পাইপলাইন যোগাযোগ, একটি বন্দর ও একটি বাঁধ। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসি) অধীন প্রকল্পগুলোও দ্রুত শেষ করতে চায় চীন। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে।

কিন্তু মিয়ানমার আগের মতো একা নয়। ভারত ও জাপান দেশটির শাসকদের কাছে টানায় চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী। সি এবার তাই এসেছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্পের তহবিল নিয়ে। এর মধ্যে অশান্ত রাখাইন প্রদেশে কিয়াউকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে বলা হচ্ছে চীনা মুকুটের রত্ন। চীনমুখী সড়ক, রেল ও পাইপলাইন এই বন্দরের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে উন্মুক্ত হবে। বহিরাগত চীন এ অঞ্চলে হয়ে উঠবে স্থানীয়দের চেয়েও বেশি স্থানীয়।

বিশ্বের সর্বত্র আমেরিকা ‘আঞ্চলিক’ বা স্থানীয় হয়ে থাকে সেনাঘাঁটি দিয়ে, আর চীন তা করে নিজের স্বার্থে অবকাঠামো প্রকল্প বানিয়ে। তাই তাদের বৈশ্বিক দাপটের স্থানীয় খুঁটি তৈরির নকশাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিকভাবে যা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), মিয়ানমারে তার স্থানীয় নাম সিএমইসি, পাকিস্তানে সিপিইসি ইত্যাদি। এই আঞ্চলিক নকশাগুলো বাস্তবায়নের ওপরই বৈশ্বিক বিআরআইয়ের সাফল্য নির্ভরশীল।

চীনের বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনের বেশিটাই হয় দক্ষিণ চীন সাগর ও মালাক্কা প্রণালি দিয়ে। কিন্তু বহুপক্ষীয় উত্তেজনায় ওই অঞ্চল এখন ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং বঙ্গোপসাগরের বন্দর তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকার।

কিন্তু চীনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর জন্য কেবল জাপান ও ভারতই বাধা নয়, বেশ কটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনতার বিক্ষোভ চলমান। রাখাইনে রোহিঙ্গা আর কাচিন প্রদেশে চীনা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিপুল মানুষ ক্ষুব্ধ। সু চি চীনের দরবারে যতটা নতজানু, মিয়ানমারের জেনারেলরা ততটা নন। চীনা ঋণ যাতে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো ফাঁদ না হয়, সে জন্য কিয়াউকফু গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ খরচ ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে। চীনের একটি খনি ও একটি বিরাট বাঁধ তৈরি বন্ধ হয়ে আছে স্থানীয় জনতার প্রতিবাদে। এ ক্ষেত্রেও সামরিক শাসকেরা নিজ জনগণকে দমন না করে বরং চীনা দুটি প্রকল্পই বন্ধ করে রেখেছেন। জবাবে চীনা অর্থায়নের অনেক প্রকল্প আটকে রেখেছে চীন।

সি চাইবেন আরও অর্থায়নের আগে খনি ও বাঁধ প্রকল্প আবার চালু করা হোক। এর সঙ্গে তুলনা করা যায় বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে চলা ২৭ প্রকল্পের ২২টিই আটকে থাকার কথা। ছাড় হয়েছে প্রতিশ্রুত অর্থায়নের ৫ শতাংশের কম। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ওই ২৭ প্রকল্প চূড়ান্ত হয়। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর ২০১৯)।

অনুরূপ পরিস্থিতি এড়াতে ইতিমধ্যে সু চি মেগা বাঁধের বিরুদ্ধের জনমত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে জিততে চীনকে তিনি পাশে চান। চীনের নীতি হলো ‘সার্বভৌমত্বে ছাড় দাও, লাভ নাও’। এর উল্টোটা হলো বিনিয়োগ বন্ধ এবং বিদ্রোহীদের উসকানো। মিয়ানমারের উন্নয়ন, সু চির ক্ষমতা, জেনারেলদের টিকে থাকা; সবকিছুর চাবি হাতে নিয়ে সি চিন পিং রাজধানী নেপিডোতে হাজির হয়েছেন সম্রাটের মতো করেই। হান যুগের চীনা সম্রাটের মতোই ক্ষমতাবান তিনি। ২০১৩ সাল থেকে তিনি প্রেসিডেন্ট। আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার আইন পাস করে সম্রাটের মর্যাদাই এখন তাঁর। নতুন বছরে মিয়ানমার সফর দিয়েই সম্রাট সির বৈশ্বিক অভিযানের শুরু।

এই বিরাট নকশায় বাংলাদেশ তো নিছক দর্শক নয়। প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী বুকে নিয়ে বাংলাদেশ কি কেবলই ক্ষতির ভাগটা পাবে, লাভ নিয়ে যাবে অন্য কেউ? রাখাইন প্রদেশে চীনা বিনিয়োগে যে চার লাখ নতুন কর্মসংস্থান হবে, তা কি রোহিঙ্গাদেরও পাওনা নয়? চীন তার মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো এশিয়ায় পাঠিয়ে নিজেরা উঠে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা আশা করেছিলেন, চীনের ছেড়ে দেওয়া ব্যবসা ধরতে পারলে বাংলাদেশের শিল্পায়ন অনেক এগিয়ে যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা গ্রাম ও ধানখেতের ওপরই বসবে পোশাক কারখানা ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা। চীনের ছেড়ে দেওয়া ব্যবসা থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার আশা ফলবে বলে মনে হয় না। ইয়াঙ্গুন ও শান প্রদেশেও শিল্পায়নে অর্থ দেবে চীন। যে শান প্রদেশে বাংলাদেশে সয়লাব হওয়া ইয়াবা ব্যবসার ঘাঁটি, সেখানে তিনটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল বানালে ইয়াবার অভিশাপ কমবে কি না, সেটাও বাংলাদেশের জন্য বড় বিবেচনার বিষয়।

বাংলাদেশের ভূসীমান্তের রাখাইনে বৃহৎ প্রকল্প ও সমুদ্রসীমা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা বিচার-বিবেচনা জরুরি।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]