সেই রূপপুর আর এই রূপপুর

ষাটের দশকের শেষ দিকে ঘটনাক্রমে কুষ্টিয়ায় আমাদের একটি বন্ধুবৃত্ত গড়ে ওঠে, তাতে ছিলেন লেখক, সংগীতশিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, অধ্যাপক প্রমুখ। নাট্যকার কল্যাণ মিত্র, লালনজীবনী লেখক অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম এবং অন্য কোনো বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা বসত। অভিনেতা রাজু আহমদও ছিলেন। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং নকশালপন্থী বাম আন্দোলন সমানতালে চলছিল। তখন মোবাইল ফোনের নামও শুনিনি। রেডিওই ছিল প্রধান ভরসা। কোনো ভাগ্যবানের অবশ্য গ্রামোফোন ও রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। আমাদের বন্ধুদের একজনেরও একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। তাতে আকাশবাণীর ভালো ভালো রেকর্ডকৃত নাটক শুনতাম। মনে আছে, তৃপ্তি মিত্র ও শম্ভু মিত্র অভিনীত আমরা দুজন একই গাঁয়ে থাকি নাটকটি শুনে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছি এবং অনেকবার শুনেছি।

কখনো আমরা শহরের বাইরে প্রকৃতির মধ্যে বেড়াতে যেতাম। কোনো দিন শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কোনো সন্ধ্যারাতে লালন শাহের আখড়ায়। ওই সময় একটি অখ্যাত এলাকা সংবাদ শিরোনাম হয়। সেটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর। আইয়ুব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম ফারুক ফ্রান্সের সরকারের সঙ্গে রূপপুর আণবিক প্রকল্পের জন্য ৫০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর রূপপুর নামটি তখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

কুষ্টিয়া শহর থেকে রূপপুর বেশি দূরে নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই একদিন সেটি দেখে আসার। এখন যেখানে লালন শাহ ব্রিজ হয়েছে, সেখান দিয়ে গড়াই নদে নৌকায় পার হয়ে রূপপুর দেখতে যাই দলবেঁধে। আমাদের সঙ্গে সদ্য বিবাহিত এক লেকচারার বন্ধুর কলেজপড়ুয়া শ্যালিকাও ছিলেন। সুতরাং সফর যতটা সম্ভব উপভোগ্য হয়েছিল।

সময়টি ছিল জাতীয়তাবাদের। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আইয়ুব সরকার ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করায় বাংলার মানুষ ওই সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। তার ফলে তারা মঙ্গল গ্রহেই লোক পাঠাক অথবা চাঁদেই অভিযান করুক বা আণবিক বোমা বানাক—মানুষ খুশি ছিল না। রূপপুর আণবিক প্রকল্প ছিল একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প।

সেদিন আমরা শুধু রূপপুর প্রান্তর নয়, ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রও ঘুরে দেখি। তখন রূপপুর ছিল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। খেসারি, মটর, মসুর, গমখেতের সমারোহ। মাঠের মাঝে মাঝে দু-একটি বাবলাগাছ। আধা-পাকা সড়কের পাশে খেজুরগাছের সারি, যেন ওরা ফসলের মাঠের পাহারাদার। এদিক-ওদিকে দু-চারটে গরু বা মোষ আলসেমি করে দিবানিদ্রা উপভোগ করছে। সড়কে মোটরগাড়ি নেই বললেই চলে, মোষের গাড়িতে আখবোঝাই। ৫২ বছর পর গত হপ্তায় সেই রূপপুর আবার দেখার সৌভাগ্য হলো। সেদিন চোখ জুড়িয়েছিল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে, সবুজের সমারোহ ও হলুদ শর্ষেখেত দেখে। এখন সেখানে সবুজের লেশমাত্র নেই। ইট, বালু, রড এবং বিচিত্র নির্মাণসামগ্রী। তার চেয়ে উপভোগ্য বহুতল আবাসিক ভবন। ১৫-২০ টির কম হবে না বড় বড় বিল্ডিং। একদিন ওগুলোতে কর্মকর্তারা আরামদায়ক জীবন যাপন করবেন।

রাস্তা থেকে বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে মনের চোখে ভেসে উঠল ওগুলোর বিভিন্ন কক্ষের আসবাবের দৃশ্য। খাট-পালঙ্ক, পর্দা, ড্রেসিংটেবিল, জাজিম-তোশক, বেডশিট, বেডকভার এবং বিশেষভাবে বালিশ। পৃথিবীর একমাত্র আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার নামের সঙ্গে বালিশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল। বিল গেটস দম্পতি বা টাটা, বিড়লার পরিবার যে দামের বালিশে ঘুমাননি, এখানকার কর্মকর্তারা তার চেয়ে অনেক বেশি দামের বালিশে ঘুমাবেন।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। চেরনোবিলের ঘটনার পর এ জিনিস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। রূপপুরে হয়তো দুর্ঘটনা হবে না, কিন্তু যদি ইস্রাফিলের শিঙ্গা ফোঁকার মতো সেই গজব নেমে আসে, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যে অবস্থা হবে, তা কল্পনা করতেও শরীরে কাঁটা দেয়।

আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার। সে জন্য কিছু ভূমি নষ্ট হবে, মানুষ ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হবে, তা মেনে নিতে হয়। কিন্তু তার পরিমাণ কত? কম বিদ্যুতেও কাজ চলে, কিন্তু ভাত ছাড়া বাঁচা যায় না সাত দিনের বেশি।

৫০-৬০ বছর আগে পরিবেশের কথা মানুষ ভাবেনি। পরিবেশবাদীরাও মাঠে নামেননি। তাই রাঙামাটিতে যখন পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হাজার হাজার চাকমাকে বাস্তুচ্যুত করা হয়, কেউ প্রতিবাদ করেনি। উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি জনপদ, ফসলের মাঠ, পাহাড়, বনভূমি, নদ-নদী ধ্বংস হয়—সে উন্নয়ন আত্মঘাতী। যেকোনো প্রকল্পই একদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ফসলের মাঠ হাজার বছর মানুষের খাবার জোগায়।

প্রায় ১১০ বছর আগে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে বহুবার গেছি। একবার ওটি হেঁটেও পার হয়েছি। এবার রূপপুর থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে গিয়ে হতবাক হয়ে যাই। একি চলছে? এ কোন ধরনের উন্মত্ততা। সিলেট ও চট্টগ্রামে পাহাড় দেখেছি, কিন্তু এই প্রথম দেখলাম বালুর পাহাড়। এ পাহাড় আল্লাহর সৃষ্টি নয়, মানুষের সৃষ্টি। গড়াই নদের বালু তুলে বানানো হচ্ছে পাহাড়। এবং সে পাহাড় কোনো অনাবাদী বিরান জায়গায় নয়, ফল-মূল ও ফসলের জমির ওপর। রাষ্ট্রযন্ত্র আছে, প্রশাসন আছে—তা মনে করার কোনো কারণই নেই। বালু ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী, তাঁদের সঙ্গে প্রশাসনের প্রণয় এতটাই গভীর যে রেলের জমি হোক বা কোনো কৃষকের লিজ নেওয়া আবাদি জমি হোক, যেকোনোখানে তাঁরা বালু ফেলে ভরাট করতে পারেন। নদীর বুক থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে প্রশাসনের প্রকাশ্য সহযোগিতায়।

‘চর এলাকায় উন্নত কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পে’র আওতায় কৃষকেরা গাজর, কলা, পেঁপে, পেয়ারা প্রভৃতি চাষ করছেন। সেগুলোর ওপর চোখ পড়েছে সরকারের। পরিবেশ তো ধ্বংস হচ্ছেই, কৃষকের জমিটাও যায়। পাকশীর এক কলা-পেঁপে-পেয়ারাবাগানের কাছে দেখি একটি সাইনবোর্ড: ‘এই জমির স্বত্বাধিকারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফোর্স বেইস স্থাপনের নিমিত্ত ব্যবহার করা হবে।’

সরকার ৭৭৫ জন কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করেছে। তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২৭ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দও করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত পেয়েছেন মাত্র ৬৯ জন। ৭০০-এর বেশি কৃষক ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য হাহাকার করছেন। টাকাটা যদি তাঁরা পানও জাতি তো ফসলটা পাবে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলে আমরা আঙুল নাচাই, কে তা উৎপাদন করেন, তার কথা মনে থাকে না। পরিবেশের কথা তো মনে থাকার কথাই নয়।

আমাদের ভূমি কম, মানুষ বেশি। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর প্রবল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সে কথা বলছেন। গত মাসেও বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি স্পেনের ফেবিয়া দ্য মাদ্রিদে (আইএফইএমএ) লিডার্স সামিটে বলেছেন, ‘আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তারা ক্ষমা করবে না। প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিস্পৃহতা পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখনই সময় কাজ করার।’ তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলোর এই পরিস্থিতি মোকাবিলার সীমিত ক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমরা দায়ী না হলেও ক্ষতির ধাক্কাটা আমাদেরকেই সামলাতে হচ্ছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, এটা একটি অবিচার এবং বিশ্বসম্প্রদায় বিষয়টি স্বীকার করবে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অসম্ভব। তার ওপর নিজেরা যদি পরিবেশ ধ্বংস করে নিজের পায়ে কুড়াল মারি, ফসলি জমি নষ্ট করি, তাহলে শুধু অর্থ ব্যয় করে টেকসই উন্নয়ন হবে না। নিজস্ব উন্নয়ন দর্শন আগে ঠিক করতে হবে। সেটা কোনো দলীয় ব্যাপার হলে চলবে না, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। পরিবেশ একটি দীর্ঘস্থায়ী বিষয়, অ্যাডহক ভিত্তিতে তার কোনো সমাধান নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক