ভাষার নতুন চমক 'ইমোজি'

ধোঁয়াশা শব্দটা খুব পুরোনো নয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত লন্ডনে পরিবেশদূষণের কারণে ধোঁয়া ও কুয়াশা একসঙ্গে মিশে সারা শহর ঢেকে যেত। তারা স্মোক ও ফগ সন্ধি করে নতুন শব্দ ‘স্মোগ’ বের করে। তার বাংলা হয় ধোঁয়াশা। ধোঁয়ার সঙ্গে কুয়াশা মিলিয়ে ধোঁয়াটের চেয়ে বেশি ঝাঁপসা ব্যাপার। অর্থটা প্রথম শোনাতেই বোধগম্য। কিন্তু হালে তৈরি ‘বিন্দাস’ শব্দের মানে কী হতে পারে, তা নতুন শ্রোতার কাছে অনুমেয় নয়। তারপর ‘ফিদা’ অথবা ‘প্যারা’ শব্দ দুটোও তাই।

তবে সহজেই বোধগম্য এমন নতুন যা এসেছে, সেটা খুবই চমকপ্রদ। ইমোজি। স্মাইলি ফেস দেখলেই খুশিটা ধরা যায়। সর্ষে ফুলের মতো উজ্জ্বল হলুদ রং থেকে বোঝা যায়, মুখের অভিব্যক্তি থেকেও ধরা যায়। তারপর আছে স্যাড ফেস, অ্যাংরি ফেস। লাভ সাইন নতুন আবিষ্কার নয়, তবে ইমোজি হিসেবে তার ব্যবহার এক লাফে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। লাইক—একটি আঙুল উঁচিয়ে সমর্থন এবং পছন্দ হওয়ার বার্তাটি জানানো। এগুলো হুড়মুড় করে সোশ্যাল মিডিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে জীবনের সবখানে ঢুকে যাচ্ছে। ভাষার অন্তর্গত হচ্ছে এবং হবে।

এ ছাড়া আছে নতুন শব্দ সংক্ষেপ, বিশেষত ইংরেজিতে। সেগুলোও ভাষায় ঢুকে যাচ্ছে। ‘বিআরবি’ বি রাইট ব্যাক। ‘লোল’ লাফ আউট লাউড। এখন এমন হয়েছে যে ‘লোল’ এ যে হাসি আছে, ‘লাফ আউট লাউডে’ও তা নেই। ব্যবহার করতে করতে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে সংক্ষেপটাতেই পূর্ণ অর্থ আরোপ করছে।

তেমনিভাবে একটি বিসর্গ দিয়ে পাশে বন্ধনী চিহ্ন দিলেই সেটাকে পাঠক দিব্য চোখে স্মাইলি ফেস হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন:)। পাশের বন্ধনী চিহ্ন উল্টো দিকে দিলে: (স্যাড ফেস হিসেবে দেখছেন। এ শুধু সমার্থক নয়, যেন সমান হয়ে গেছে।

ইমোজির ব্যবহারের কথায় আসা যাক। ইমোজি শুধু বালক-বালিকাদের খুদে বার্তা বা ফেসবুকের কথাবার্তার অংশ নয়। দুনিয়াজুড়ে ইমোজির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। এর কোনো দেশ-কাল-পাত্র বা বয়স ভেদ নেই। ২০১৫ সালে খোদ অক্সফোর্ড ডিকশনারি বর্ষসেরা শব্দগুলোর একটি হিসেবে ইমোজিকে ঘোষণা দিয়েছে। হাসতে হাসতে দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, সেই ইমোজিটি হয়েছে বর্ষসেরা ‘শব্দ’! অর্থাৎ প্রতীককেই এখানে শব্দ ভাবা হয়েছে। এটাই প্রথম ইমোজি যা ডিকশনারিতে শব্দ হিসেবে স্থান পেল। যেনতেন শব্দ নয়, বর্ষসেরা শব্দ।

আমেরিকার একটি কোম্পানি রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেছে, তারা অফিশিয়াল ই–মেইলেও ইমোজি ব্যবহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। কথায় আছে ‘এ পিকচার ইজ ওয়ার্থ থাউজেন্ড ওয়ার্ডস’—একটা ছবি হাজার শব্দের সমান। ইমোজি তো ছবিই। ‘ইমোজি’ নিজে জাপানি শব্দ। প্রথম আবিষ্কারও হয়েছে জাপানে। ডোকোমো নামের ফোন কোম্পানির একজন প্রকৌশলী গ্রাহকদের সঙ্গে ভাবের আদান–প্রদানের সহজ উপায় হিসেবে ইমোজি তৈরি করেন। ইমোজির অর্থ হলো ‘ছবি চরিত্র’ (picture character)।

ছবির বাইরেও ভাষায় ইমোজির আরেক শক্তি আছে। তা হলো লেখকের মনোভাবটা বোঝানো। যেমন কাল সবাই সাদা পোশাক পরে আসুন। বলে মেইল করা হলো। এটা কি অফিসের বস জুনায়েদ সাহেব বেজার হয়ে বললেন, রাগ নিয়ে বললেন, নাকি মজা করে বললেন, শুধু ই–মেইলের শব্দগুলো পড়ে সেটা পরিষ্কার হলো না। পাশে একটা স্মাইলি ফেস দিয়ে দিলে তা মুহূর্তেই জুনায়েদ সাহেবের মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলত।

ফোন টেক্সট, টুইট, চ্যাট, এগুলোর মতো গল্প-উপন্যাসেও ইমোজির ব্যবহার চলে আসবে। এমনকি শুধু ইমোজি দিয়ে ইতিমধ্যেই মবিডিকের মতো বই অনুবাদ করা হয়ে গেছে। পণ্ডিতেরা ইমোজিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এ হলো ভাষায় বিশ্বব্যাপী বোধগম্য শব্দের বৈপ্লবিক সংযোজন।

কিন্তু অন্যদিকে একটা বিশেষ শব্দ বাংলা ভাষায় এমন ভাবে ‘জায়গা’ করে নিচ্ছে যে অনেক শব্দকে অচিরেই ‘জায়গা’ ছেড়ে দিতে হবে। শব্দ ও ভাষার যে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ও আবেগ আদান–প্রদানের ক্ষমতা আছে, সেটা ক্রমেই লোপ পেয়ে যাবে। সেই জায়গাটাতেই আসছি।
পাঠক হয়তো ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছেন আমি কোন জায়গায় যাচ্ছি।

একজন বলেন, ‘আমাদের একটা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।’ ওই বিকল্প শব্দটি বক্তা ব্যবহার করার কারণে বাক্যটা এমন দাঁড়াল, ‘আমাদের একটা জায়গা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে হবে।’
আবার ধরুন, ‘আমাকে তো আপনি কথা বলার অবকাশ দিচ্ছেন না?’

সেটা হয়ে গেল, ‘আমাকে তো আপনি কথা বলার জায়গা দিচ্ছেন না?’

এভাবে একজন বলেন, দেখেছেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা দিন–রাত ফেসবুক করে করে কেমন গোল্লায় যাচ্ছে?

কিন্তু ওই শব্দটির প্রভাবে বললেন, দেখেছেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা দিন–রাত ফেসবুক করে করে কোন জায়গায় যাচ্ছে?

তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেখানেও বলা হবে, তথ্যপ্রযুক্তি একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা তৈরি করতে হবে।

তাসের একটা খেলা আছে, যেখানে ‘জে’ লেখা জোকার তাসটি অন্য যেকোনো প্রকার তাস হয়ে যেতে পারে। খেলোয়াড়ের রুইতনের দশ দরকার, পেল জোকার, তখন জোকারই রুইতনের দশ। অথবা ইস্কাপনের রানি দরকার, জোকারই রানি হয়ে গেল।
‘জায়গা’ কথাটা এভাবে বহু সুনির্দিষ্ট এবং ভীষণ অর্থবহ শব্দকে সরিয়ে দিচ্ছে। সচেতন অথবা অবচেতনভাবে সম্প্রতি কথ্য বাংলা ভাষায় এই শব্দটি ক্রমেই ‘জায়গা’ করে নিচ্ছে।

ইমোজি ভাষার মধ্যে মনের একটা মধুর রং মিশিয়ে দিতে পারে। ইমোজির প্রকাশভঙ্গি চিরন্তন। ‘জায়গা’ বা এমন বহুল ব্যবহৃত সাদামাটা বিকল্প শব্দগুলো তার উল্টো কাজ করছে। ভাষায় অস্পষ্টতা এনে দিচ্ছে, পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শ্রুতির মাধুর্য কমিয়ে দিচ্ছে।
কাজেই সেই জায়গাতেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।