ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডই কি সমাধান?

পত্রপত্রিকাগুলোতে গত কয়েক দিনে ধর্ষণের ঘটনায় যে প্রতিবাদগুলোর ছবি বা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখেছি, ধর্ষণ বন্ধে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডকেই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন অনেকেই। ক্রমাগত ধর্ষণের সংবাদে সাধারণ মানুষের মনে যে হতাশা আর ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভ ঘনীভূত হয়েছে, তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনেককেই আমি বলতে শুনেছি, ধর্ষককে আটক করা মাত্র গুলি করে মেরে ফেলাই একমাত্র সমাধান। কেউ কেউ আবার জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার কথাও বলছেন। ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিচারহীনতার যে দীর্ঘ ইতিহাস, সেই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের এমন আবেগতাড়িত বক্তব্য স্বাভাবিক। তবে যখন রাষ্ট্রের আইনপ্রণেতা এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকেরা ধর্ষণ বন্ধের একমাত্র ফর্মুলা হিসেবে কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করেন, তখন তা প্রকারান্তরে আইনের শাসনের উপস্থিতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ডই দিতে হবে—সাধারণ মানুষের এই দাবির ভাষাতেও বোধ করি পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেই যদি ধর্ষণ বন্ধ করা যেত, তবে কিন্তু গত ২০ বছরে যে ক্রমাগত ধর্ষণের পর হত্যা বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেটি হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের ২০০০ সালের যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে, যার অধীনেই ধর্ষণের মামলাগুলো বিচার করা হয়, তাতে কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া রয়েছে। আইনটির ধারা ৯ বলছে, যদি ধর্ষণের কারণে নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তবে শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন, এর নিচে নয়। একই ধরনের শাস্তির কথা বলা আছে দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রেও এবং সে ক্ষেত্রে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু ছাড়াও শুধু আহত করলেও একই শাস্তির বিধান রয়েছে।

এই ক্ষেত্রগুলো ছাড়া সাধারণভাবে ধারা ৯ বলছে, যেকোনো ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই একমাত্র শাস্তি হবে যাবজ্জীবন, যার কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। অর্থাৎ অপরাধ প্রমাণিত হয়ে গেলে একজন বিচারক চাইলেও কোনো অপরাধীকে কম মাত্রার শাস্তি প্রদান করতে পারবেন না, যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতেও। সব মিলিয়ে যদি দেখা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি শাস্তির দিক থেকে অত্যন্ত কঠোর একটি আইন। কিন্তু তাতে কি নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার চিত্রে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে গত ২০ বছরে? বরং বর্তমান পরিসংখ্যানগুলো তার উল্টোটাই বলছে।

তাই প্রথমে খুঁজে দেখা দরকার কেন এত কঠিন শাস্তির পরও ধর্ষণের ঘটনা না কমে বরং বেড়েই চলেছে। শাস্তি বাড়ানো অথবা সব ক্ষেত্রে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলে তা হয়তো কিছু সময়ের জন্য জনমনে স্বস্তি দিতে পারে, তবে শুধু শাস্তি বাড়ালেই সমস্যার সমাধান হবে না, এই ব্যাপারটি মোটামুটি নিশ্চিত। ভারতেও যখন সম্প্রতি শিশু ধর্ষণের শাস্তিকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হলো, অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকই মন্তব্য করেছিলেন যে সেটি ছিল জনগণের মনভোলানো কৌশল মাত্র এবং আদতে তাতে শিশু ধর্ষণের চিত্র পরিবর্তিত হয়নি।

শুধু ধর্ষণ নয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি যৌতুকের কারণে হত্যাসহ আরও বেশ কয়েকটি অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডকে সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করেছে, যদিও তাতে অপরাধ দমনে খুব একটা প্রভাব পড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তির কঠোরতা অপরাধ দমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেও মনে করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটিতে অনেক মামলা হলেও আমরা দেখেছি আসামির দণ্ডাদেশের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যাঁরা আইন বিশ্লেষক আছেন দেশে এবং বিদেশে, তাঁরা কিন্তু অনেকেই গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে বলেছেন যে যখন কোনো অপরাধের শাস্তি অতিমাত্রায় গুরুতর হয়, তখন এটি অপরাধকে না কমিয়ে বরং আসামির দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনাকেই কমিয়ে দেয়।

একজন বিচারককে যখন দোষী প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনই দিতে হয়, তখন দোষী সাব্যস্ত করার আগে একজন বিচারক স্বাভাবিকভাবেই এক শ ভাগ নিশ্চিত হতে চাইবেন অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। এর প্রভাব পড়বে অপরাধের শিকার ব্যক্তির ওপরই। দেখা গেছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ খুঁটিনাটি প্রমাণ করার বোঝা থাকে বাদীপক্ষের ওপর, তাতে শেষমেশ একজন দোষী ব্যক্তিও খালাস পেয়ে যান যথাযথ প্রমাণের অভাবে। ধর্ষকের তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড দাবি করার আগে তাই এই বিষয়গুলোও ভাবার দরকার।

আমার মনে হয়, প্রতিবাদের ভাষা হওয়া উচিত বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ধর্ষকের দ্রুত বিচার আর ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ন্যায়বিচার দাবি করে। প্রতিবাদ হওয়া উচিত এমন, যা রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে পারে যে সময় হয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর। সেই সদিচ্ছার প্রতিফলন সত্যিকার অর্থে তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন ধর্ষণ বন্ধে নীতিনির্ধারকেরা সংবিধানকে সমুন্নত রেখে তাঁদের অভিজ্ঞতা, সদিচ্ছা আর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সঠিক নীতি প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেবেন। আইনপ্রণেতারাও যদি আবেগপ্রবণ হয়ে আইনের শাসনের বিপক্ষে ধারণা পোষণ করেন, তা শুধুই ধর্ষণের বিচারহীনতার প্রতি সাধারণের হতাশায় আরও মাত্রা যোগ করবে।

তবে ধর্ষণ কী করে দমন করা যাবে, এই প্রশ্নের উত্তর যেমন জটিল, তেমনি নীতিনির্ধারকদের জন্যও এই সহিংসতা বন্ধের উপায় বের করা একটি জটিল ও সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে ধর্ষণ বন্ধে শুধু আইনপ্রণেতারা নন, বরং বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকেই সমান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাই ধর্ষকের তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ডের দাবি নয়, বরং উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ধর্ষণের জন্য প্রচলিত আইনগুলো সংবেদনশীল আর যুগোপযোগী করার। দেখতে হবে বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা কতটুকু নারীবান্ধব এবং কতটা সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্লেষণ করতে হবে, আইন ও বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত কী কী ভোগান্তির মুখোমুখি হন, আর তার সমাধান কী করে করা যায়।

সর্বোপরি, যদি ধর্ষণের বিচারব্যবস্থায় অর্থবহ কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তবে আইন প্রণয়ন বা সংশোধন শুধু নয়, বরং আইন প্রয়োগের পুরো পদ্ধতিটিকেই স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই, সেটি যতই সুদূর মেয়াদি লক্ষ্য হোক না কেন।

তাসলিমা ইয়াসমীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]