শিক্ষাবঞ্চিত রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ কী

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সব শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করতে হবে। ছবি: রয়টার্স
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সব শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করতে হবে। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে যখন আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালিত হচ্ছে, তখন ৫০ লাখের মতো শিশু বাংলাদেশে বেড়ে উঠছে শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায়। কখনো কোনো শ্রেণিকক্ষের ভেতরটা না দেখা এসব শিশুর মধ্যে শুধু ৪৩ লাখ বাংলাদেশিই নয়, ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশুও রয়েছে। এসব শিশু কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরগুলোতে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপন করছে।

শরণার্থীরা কি নিরাপদে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হবে, নাকি তারা তৃতীয় কোনো দেশের শরণাপন্ন হবে? না অন্য কোনো উপায়ে হবে সংকটের সমাধান? এসব নিয়ে আমরা যত আলাপ করি না কেন, শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায় বড় হলে রোহিঙ্গা শিশুদের একটি প্রজন্ম ভবিষ্যতে নিজেদের
অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ হারাবে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো অথবা যেখানে বাস করবে, সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখারও সুযোগ পাবে না তারা। আড়াই বছর ধরে তাদের জীবন থমকে আছে, অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে অচল হয়ে পড়ে আছে ভবিষ্যৎ। আমি যেসব রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কারও কারও স্কুলের পড়াশোনা পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার পর্যায়ে ছিল, এমন সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে ওই শিশুরা আরও দুটি শিক্ষাবর্ষ হারিয়েছে। যত দীর্ঘ সময় তারা ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, শিশু হিসেবে যেসব অধিকার তাদের পাওয়ার কথা, সেগুলো অর্জনের সম্ভাবনা তত সুদূরপরাহত হয়ে উঠছে। তারা একটি ‘হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

কক্সবাজারের স্থানীয় বাংলাদেশি শিশুরাও একই রকম দুর্ভাগ্য বরণ করছে। ইউএসএইডের ২০১৮ সালের ‘র‍্যাপিড এডুকেশন অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস’ রিপোর্টের তথ্যমতে, কক্সবাজারে প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার উপযোগী বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার হার মাত্র ৭১ শতাংশ, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন, একই সঙ্গে ঝরে পড়ার হার এখানে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ।

২০১৭ সালে বিশালসংখ্যক শরণার্থীর আগমন স্থানীয় অর্থনীতিতে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ইউএসএইডের একটি রিপোর্ট মতে, সেখানে জীবনধারণের ব্যয় বেড়েছে পাঁচ থেকে সাত গুণ, দক্ষ শিক্ষকেরা স্কুল ছেড়েছেন এবং রোহিঙ্গা শিবিরে কাজের সুযোগ পেতে কক্সবাজার এলাকার শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। এসব বিষয় স্থানীয় বাংলাদেশি শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সব শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করতে হবে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে এবং বাংলাদেশে শিশুদের যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে আগ্রহী।

আমাদের জন্য বেশি গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করার বিষয় হলো একটি প্রজন্মের শিক্ষাবঞ্চিত অবস্থায় বেড়ে ওঠার পরিণতি। শিক্ষা ছাড়া বেড়ে উঠলে কোনো প্রজন্ম নিজেদের পক্ষে কথা বলা বা অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার মতো সক্ষম হয়ে উঠবে না। সক্রিয় ও আলোকিত মননের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে নানা সুবিধা ভোগ করা কিংবা নিজেদের কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

জাতিসংঘের বাধ্যতামূলক শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এতে স্পষ্ট বলা আছে, শিক্ষা এমন হওয়া উচিত, যা শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন, মেধা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশের পাশাপাশি মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনযাপনে প্রস্তুত করে তোলার নিশ্চয়তা দেয়।

এটা আশাব্যঞ্জক যে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ অনুধাবন করেন। যে দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনকে অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেখানে চতুর্থ নম্বর লক্ষ্য (মানসম্মত শিক্ষা) অর্জনও একটি টার্গেট হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা সবার আগে হওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা তরুণ একটি মতামত নিবন্ধে লিখেছেন, শুধু পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গা তরুণদের যেসব প্রজন্ম নিপীড়নের নিশানায় পরিণত হয়েছে, তাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পদক্ষেপ নিতে পারে।

আমাদের নিজেদের এই প্রশ্নটাও করতে হবে, বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া একটি দেশ কি একটি প্রজন্মকে পেছনে রেখে এগোতে পারবে? বরং আমরা ধনী দেশগুলোকে উৎসাহিত করছি বিরাটসংখ্যক শরণার্থী আগমনের কারণে বাংলাদেশ যে সংকটে পড়েছে, তাতে নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও যদি এই মুহূর্তটি কক্সবাজারের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজে লাগায়, তা হবে ইতিবাচক পদক্ষেপ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘কক্সবাজারে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে কানাডার ১৬ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প’ রয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত চলবে। ‘কক্সবাজারে শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা জোরদারকরণে’ ৫ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। দুটি প্রকল্পই স্থানীয় এবং রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ১২৭ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিক্ষার সুযোগ এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগী সদস্যদের জন্যও সহায়তা রয়েছে।

এসব সহায়তাকে স্বাগত, তবে আরও অনেকই কিছু করা প্রয়োজন। বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’-এর চলতি বছরের আবেদনে। ২০২০ সালে শরণার্থী সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য তারা মোটামুটি ৮৭৭ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের আবেদন জানাবে।

রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাংলাদেশি সম্প্রদায় উভয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষা করে এমন যথাযথ, স্বীকৃত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজন। আর এ জন্য যেসব জিনিসপত্র ও সহায়তা দরকার, তা নিয়ে আরও আলোচনা হতে হবে। কিন্তু এটা শুধু তখনই সম্ভব, যখন বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার নীতিগতভাবে এটার গুরুত্ব মেনে নেবে এবং সমর্থন জানাবে। এই সমর্থন জানানোর একটি উপায় হতে পারে এই পিটিশন স্বাক্ষর করা।

সাদ হাম্মাদি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া ক্যাম্পেইনার
টুইটার:@saadhammadi