আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ

দ্য হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় সত্য, সভ্যতা ও মানবতার জন্য মাইলফলক বিজয়। গণতন্ত্র, সুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতিতে জেরবার বিশ্বব্যবস্থায় জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতের আদেশ একটি প্রশান্তি বয়ে এনেছে। বহুকাল পরে মানুষ যখন জাতিসংঘের অকার্যকারিতা নিয়ে হতাশ, তখন হেগের স্রোতোধারা ভোলগা থেকে পোটোম্যাক হয়ে মিশে গেছে নাফ ও বুড়িগঙ্গায়। তাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে এ রকম একটি সর্বসম্মত আদেশ সব বিচারে অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা গাম্বিয়া, বিশেষ করে দেশটির আইনমন্ত্রী এবং ওআইসির প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

এই আদেশ প্রমাণ করছে যে, সময়ে সময়ে যথেষ্ট স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্ব সংস্থার বিচার বিভাগ মানবতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারেন। বিশেষ করে, যখন কোনো কিছুই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাইরে নয়। যেখানে আমরা চীনসহ শক্তিশালী দেশগুলোর তরফে রোহিঙ্গা গণহত্যাসংক্রান্ত অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানি, সেখানে আইসিজের বিচারক প্যানেলে থাকা চীন, এমনকি মিয়ানমার যাকে অ্যাডহক বিচারক নিয়োগ দিয়েছে, তিনিও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী আদেশ প্রদানে পিছিয়ে যাননি। বিশ্ব সভ্যতা, আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি সর্বসম্মত বিচার বিভাগীয় বিবেকের সর্বোচ্চ আদর্শস্থানীয় দৃষ্টান্ত অবলোকনের বিরল সুযোগ পেল।

মিয়ানমারের তরফে আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যানে কোনো বিস্ময় নেই। তবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, একদা মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন নেত্রী অং সান সু চি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়েছেন। আইসিজেতে তিনি তাঁর দেশের পক্ষে গণহত্যার দায় এড়িয়ে ‘সশস্ত্র সংঘাতের’ যে তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন, সেটা পুরোপুরি নাকচ হয়ে গেছে। দ্য হেগ থেকে দেশে ফিরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন সু চি। তখন একটি অনুকূল আদেশ পাওয়ার বিষয়ে তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তাঁর ও তাঁর সরকারের জেনারেলদের সেই আশাবাদ গুঁড়িয়ে গেছে।

সুতরাং আমরা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলব, এখন এই আদেশ যদি মিয়ানমারের জনগণের চোখ খুলে দিতে পারে এবং সেখানে সামান্য অগ্রগতি হলেও সেটাই হবে এই সর্বসম্মত আদেশের সব থেকে বড় সার্থকতা। কারণ, রোহিঙ্গাদের দরকার নাগরিকত্বের প্রশ্নের স্থায়ী সমাধান। কিন্তু সেই বিষয়ে আইসিজের এখতিয়ার নেই। তাঁরা কেবল রাষ্ট্রকে দোষারোপ করতে পারবেন। তাই মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের প্রতি জনমত গঠনে এই আদেশের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে আমরা জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি অনুরোধ রাখব, যাতে তারা এই আদেশ বর্মি ভাষায় অনুবাদ করে তা মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে প্রচারের উদ্যোগ নেয়। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, হেগের আদেশটি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিদ্বেষপ্রসূত ধারাবাহিক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক সমুচিত জবাব।  

আমরা বিশ্বাস করি, এই সর্বসম্মত বিচার বিভাগীয় আদেশের অসামান্য প্রভাব যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে যে, সভ্যতার সংঘাতের তত্ত্ব ভ্রান্ত। বহু জাতি, বর্ণ ও গোত্রের বিবেকবান বিচারকেরা আজ এক কণ্ঠে মানবতার জয়গান গাইতে পেরেছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সার্বিক কার্যক্রম অধিকাংশ সময় অপরিচ্ছন্ন এবং সংকীর্ণ জাতীয় বা জোটগত স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত বলেই প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে, আমরা স্মরণ করতে পারি যে, রোহিঙ্গা গণহত্যার দুই বছর পরেও ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বিবেচনাতেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অপারগ থেকেছে।

আশা করব, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসবে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা পরিষদের আশু করণীয়র তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। শুধু নিরাপত্তা পরিষদই নয়, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সরকার, বিশেষ করে যারা মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তাদের তরফে একটা আশু আচরণগত পরিবর্তন আশা করি। জয়তু মানবতা।