চমকপ্রদ কিছু বলছি না, সবই বাস্তব পরিকল্পনা : তাপস

>আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকা সিটি নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি ঢাকার বৃহত্তর ধানমন্ডি আসনে পরপর তিনবার নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন। নির্বাচন সামনে রেখে তিনি নির্বাচনী পরিস্থিতি, প্রচার-প্রচারণা ও নিজেদের নগরভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন

প্রথম আলো: কেন ঢাকার নাগরিকেরা আপনাকে মেয়র নির্বাচিত করবেন?
শেখ ফজলে নূর তাপস: ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই উন্নত বাংলাদেশের উন্নত রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে। তাই ঢাকাবাসীর জন্য পাঁচটি ভাগে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করেছি। এগুলো হচ্ছে ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা, সচল ঢাকা ও উন্নত ঢাকা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ধরে রেখেই ৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলা হবে। বিশ্বের অনেক শহর মাত্র একটি নদীর অববাহিকায় তৈরি। অথচ দুটি নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা ঢাকাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারছি না। ভঙ্গুর ঢাকাকে বাঁচিয়ে তুলতে দুই নদীকে ঘিরে পরিকল্পনা নেওয়া হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মাঠ, খেলার জন্য উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করা হবে। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অচল ঢাকাকে সচল করা হবে। ডিএসসিসি হবে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত। আমাদের ঘোষিত রূপরেখা নিয়ে ঢাকাবাসীর কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাচ্ছি। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সব মৌলিক সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হবে। 

প্রথম আলো: নগরবাসীর বড় আতঙ্ক মশাবাহিত রোগ। মশকনিধনে আপনি কী ভাবছেন?
শেখ ফজলে নূর: এটা ঢাকাবাসীর মৌলিক নাগরিক সেবার মধ্যেই পড়ে। বছরে নির্দিষ্ট সময়ে নয়, এটা আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ হবে। ২৪ ঘণ্টা নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা হবে। মশকনিধন কার্যক্রমও অত্যাবশ্যকীয় সেবা, এটি দৈনিক চালানো হবে। 

প্রথম আলো: অতীতে কোনো মেয়র পারেননি, আপনি কীভাবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন?
শেখ ফজলে নূর: এটি নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা দেখিনি। তবে এটি কোনো জটিল সমস্যা নয়। শুধু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব। কোনো দেশে বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায় না। নগর ভবনে ২৪ ঘণ্টা যেহেতু সেবা থাকবে, যে কেউ ময়লার বিষয়ে জানাতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে।

প্রথম আলো: পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কার হলেও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। আপনার পরিকল্পনা কী?
শেখ ফজলে নূর: এটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হলেও রক্ষণাবেক্ষণে দেওয়া হয় না। আমরা এদিকে নজর দেব। রক্ষণাবেক্ষণও প্রকল্পের অংশ করা হবে।

প্রথম আলো: ওয়াসা, ডেসকো, ডিপিডিসি, টেলিকম প্রতিষ্ঠান মিলে নিয়মিত খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হয় ঢাকার রাস্তায়। সরকারি সংস্থার সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করার কথা ভাবছেন?
শেখ ফজলে নূর: ডিএসসিসি ঢাকাবাসীর কাছে দায়বদ্ধ। তাই অন্য সংস্থার যত্রতত্র কাজ করা রোধ করা হবে। পয়লা বৈশাখের আগে সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাহিদাপত্র নেওয়া হবে। এরপর তাদের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তাদের কাজ করার পর ডিএসসিসি কাজ করবে। আর ডিএসসিসি কাজ করার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে রাস্তায় কেউ কাজ করতে পারবে না।

প্রথম আলো: ফুটপাত দখল ও চাঁদাবাজি নিরসনে একাধিকবার আগের মেয়রের উদ্যোগ দেখা গেছে, কিন্তু সমাধান হয়নি। আপনি কীভাবে এর সমাধানের কথা ভাবছেন?
শেখ ফজলে নূর: ঢাকার হকাররা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে জিম্মি। টাকার বিনিময়ে হকাররা রাস্তায় বসেন। তাঁদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করার কোনো সুযোগ নেই। এক দিনে সব রাস্তা হকারমুক্ত হবে না। সড়ক চিহ্নিত করে হকারদের তথ্যভান্ডার করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসনের মাধ্যমে রাস্তা হকারমুক্ত করা হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। 

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশনগুলোর ব্যয়ের বড় অংশ আসে সরকারের থোক বরাদ্দ থেকে। সিটি করপোরেশনের নিজের আয় নিয়ে কী ভাবছেন?
শেখ ফজলে নূর: সিটি করপোরেশন সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আয় বাড়ানোর অনেক সুযোগ ছিল, ব্যবহার করা হয়নি। সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে তো স্বায়ত্তশাসন প্রয়োগ করা যাবে না। তাই অচিরেই এটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাব। আয় বাড়াতে নাগরিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স বা কর বাড়ানো হবে না। বরং সমন্বয়ের মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর কমতে পারে। রাজস্ব আহরণের অন্যান্য অনেক দিকে নজর দেব। কর না বাড়িয়েও রাজস্ব বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে।

প্রথম আলো: ঢাকাকে, বিশেষ করে রাতের ঢাকাকে নারীবান্ধব করতে আপনার পরিকল্পনা কী?
শেখ ফজলে নূর: সুন্দর ঢাকা ও সচল ঢাকার আওতায় এটি থাকবে। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই জরুরি। সিসি ক্যামেরা দিয়ে সব জায়গা নজরদারির ব্যবস্থা করা হবে। অন্ধকার সড়কে অপরাধপ্রবণতা থাকে। তাই সব সড়ক ২৪ ঘণ্টা আলোকিত রাখার ব্যবস্থা করা হবে।

প্রথম আলো: পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, সমন্বিত বাস চলাচল ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সমন্বয় হয়নি, আপনি কী ভাবছেন?
শেখ ফজলে নূর: প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের পরিকল্পনা যাচাই করে দেখছি। আমরা পুরো পরিবহনব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করতে চাই। অনেক শহরে শুধু হাঁটার রাস্তা থাকে, আমাদের নেই। আমরা বিভিন্ন ধরনের রাস্তা করব। হেঁটে চলা, দ্রুত যানের রাস্তা, ঘোড়ার গাড়ির রাস্তাও থাকবে।

প্রথম আলো: ঢাকার দূষণের হার অনেক বেশি। পরিকল্পনা করলে যে নগরীর দূষণ কমানো যায়, এটা ইতিমধ্যে রাজশাহী করে দেখিয়েছে। ঢাকার দূষণ কি কমানো সম্ভব?
শেখ ফজলে নূর: সুন্দর ঢাকার আওতায় দূষণ রোধের কার্যক্রম নেওয়া হবে। গত ২০ বছরে ঢাকায় সবুজায়নের তেমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। আমরা ব্যাপক হারে তা শুরু করব। নিশ্বাস নেওয়ার মতো সবুজ জায়গা প্রতিটি ওয়ার্ডে করতে চাই।

প্রথম আলো: প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাতে নগরবাসীর প্রত্যাশা বেড়েছে, এতে আপনি কতটা চাপ অনুভব করেন।
শেখ ফজলে নূর: আমি চমকপ্রদ কিছুই বলছি না। আমার টুপি থেকে কোনো জাদুর বাক্স বের হবে না। যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সবই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক দেখিয়েছেন, চাইলে করা সম্ভব। তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। সংসদ থেকে পদত্যাগ করে মেয়র নির্বাচনে এসেছি। আর দেরি হলে ঢাকা অনেক পিছিয়ে যাবে। তাই সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ জেনেই নেমেছি। সততা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রম করে এগোলে অবশ্যই সম্ভব।

প্রথম আলো: বিএনপির প্রার্থী পুরান ঢাকার। তিনি প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। তাঁর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী, কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আশা করছেন?
শেখ ফজলে নূর: আশা করছি, খুব ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। ভোটারদের দোরগোড়ায় যাচ্ছি। জনগণ আমাদের রূপরেখা সাদরে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ করছি, আমাদের প্রতিপক্ষ শুধু অভিযোগ নিয়ে ব্যস্ত। তারা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। নিজেরাই বারবার বলছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে এসেছে। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় লিপ্ত আছে। আর আমরা ঢাকাবাসীর উন্নয়ন নিয়ে গণসংযোগে ব্যস্ত। তাই ঢাকাবাসী নৌকায় ভোট দিয়ে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য সেবক নির্বাচিত করবেন।

প্রথম আলো: লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে বিএনপির অভিযোগ কীভাবে দেখছেন।
শেখ ফজলে নূর: নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা দেখছি না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিদ্যমান রয়েছে। সবাই নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ করতে হয়, তাই করছেন। নতুন করে ইভিএমের ব্যাপারে বিএনপি কথা বলছে। ভোট দেওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে ইভিএম ঢাকাবাসী সদরে গ্রহণ করেছেন। একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে ঢাকাবাসী তাঁদের সেবক নির্বাচিত করবেন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ ফজলে নূর: ধন্যবাদ।