স্বাধীন হওয়ার জন্য দরকার ইচ্ছা ও মেরুদণ্ড

কয়েক সপ্তাহ আগে এক-এগারোর ১৩ বছর পার হলো। ২০০৭ সালের ওই দিন দেশের রাজনীতিতে রীতিমতো একটি সুনামি ঘটে গিয়েছিল। এটি কাউকে ক্ষমতার চূড়ায় বসিয়েছে। কাউকে খাদে ফেলে দিয়েছে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় এক-এগারোর দুই বছর ছিল উথালপাতাল। এটি ভোলার নয়। তবে যাঁরা এর ভিকটিম ছিলেন, তাঁদের কাছে এটি দুঃস্বপ্ন। তাঁরা চাইবেন ভুলতে। কিন্তু চাইলেই কি ভোলা যায়?

এক টক শোতে আমি বলেছিলাম, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েই এক-এগারো ঘটেছিল। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐকমত্য থাকলে ‘তৃতীয় শক্তি’ কখনোই নাক গলানোর সুযোগ পায় না। উদাহরণ হিসেবে আমি এ দেশে তিনবার সামরিক হস্তক্ষেপের উদাহরণ টেনেছিলাম—১৯৭৫,১৯৮২ ও ২০০৭। আমি বলেছিলাম, সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে যখনই কোনো রাজনৈতিক পক্ষ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, বিরোধী পক্ষগুলো তাকে স্বাগত জানিয়েছে। ওই তিনবার এটি দেখা গিয়েছিল। আমার বক্তব্য না বুঝে একজন রাজনৈতিক নেতা গোসসা করেছিলেন। এমনকি টক শোর সঞ্চালকও অতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। এ দেশে এ ধরনের শো সঞ্চালনা করার জন্য যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক করতে হয়, তা তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করেন না। সঞ্চালকের যে কোনো পক্ষ নেওয়া অনৈতিক—এ বোধটুকুও তাঁদের মধ্যে কাজ করে না। এ দেশে গণমাধ্যমের সাবালক হতে এখনো অনেক বাকি।

ফিরে আসি এক-এগারো প্রসঙ্গে। কেউ চটজলদি মন্তব্য করে বসতে পারেন। আমি বুঝি এর কুশীলবদের পক্ষে ওকালতি করছি। আমি বুঝি অনির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চাই। আসলে তা নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি ছিল অনিবার্য। এর শর্তগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন ঝগড়াটে রাজনীতিবিদেরা। তখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। দুদকে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। এ রকম দাওয়াতের অর্থ হলো, আপনি কেটে পড়ুন। তো তাঁরা সবাই ‘পদত্যাগ’ করলেন। লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদক পুনর্গঠিত হলো। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মেজর জেনারেল এম এ মতিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা দুদককে ক্লাউনমুক্ত করেছি।’ কথাটি আমার মনে ধরেছিল। এক-এগারোর আগের বিএনপি-জামায়াত সরকার দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে প্রমোশন দিয়ে ‘কমিশন’ তৈরি করেছিল। বলা যায়, দুদক হলো বিএনপি সরকারের সৃষ্টি। কিন্তু শুরু থেকেই এটি ছিল অকেজো। সদস্যরা উল্টাপাল্টা কথা বলতেন, একে অন্যের বিরুদ্ধে বেফাঁস মন্তব্য করতেন এবং একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে মুখ-দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জেনারেল মতিনের মন্তব্যটি বেশ জুতসই মনে হয়েছিল।

হাল আমলে নির্বাচন কমিশনের অবস্থা অনেকটাই ওই সময়ের দুদকের মতো। তাঁরা কখন কী বলেন, তার ঠিক নেই। একজন যদি বলেন উত্তরে যাব, তো আরেকজন বলেন দক্ষিণে। কমিশনের ক্ষমতা বেশি না সচিবের প্রতাপ বেশি, তা বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। সচিব তো কমিশনকে প্রায়ই বুড়ো আঙুল দেখান। এসব কাণ্ডকারখানা চলছে প্রকাশ্যেই।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে শিগগিরই। এ নিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। শুরুতেই হলো তারিখ নিয়ে বিভ্রাট। সরস্বতীপূজা তো এ দেশে নতুন নয়। যাঁরা কমিশনে আছেন, আমি ধরে নিচ্ছি তাঁরা একসময় স্কুলে পড়তেন। সরস্বতীপূজা উপলক্ষে স্কুল ছুটি থাকে। অনেক স্কুলে পূজা হয়। নির্বাচনের সময় স্কুলগুলোই হয় ভোটকেন্দ্র। কোন আক্কেলে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনের জন্য পূজার ওই দিনটি ঠিক করলেন? জনসম্পৃক্ততার ন্যূনতম ধারণা ও অভিজ্ঞতা থাকলে তো এমন হওয়ার কথা নয়।

নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার পরপরই সেদিন প্রতিবাদ হয়েছিল। কিন্তু কমিশন তারিখ বদলাল জল অনেক ঘোলা করে। কেন? তারা কি কারও নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল? কাগজে-কলমে কমিশন স্বাধীন হলে তারা চটজলদি একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কালক্ষেপণ কেন হলো? সাংবাদিকদের মাইক্রোফোন সামনে দেখলে কমিশনের সদস্যা তো হুমড়ি খেয়ে পড়েন মনের কথা উগরে দেওয়ার জন্য। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তাঁরা চুপচাপ বসে থাকলেন কেন? এতগুলো কেনর জবাব পাওয়া যাবে না। ‘তুমি স্বাধীন’ বললেই কি কেউ স্বাধীন হতে পারে? স্বাধীন হওয়ার জন্য ইচ্ছাশক্তি থাকতে হয়। দরকার হয় মেরুদণ্ডের।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনেক আগেই বলেছিলেন, সবাই যদি একমত না হন, তাহলে ইভিএমে ভোট হবে না। বড় একটি দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। তারা কমিশনে গিয়ে এ কথা জানিয়ে এসেছে। নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। আমরা তো সামনের দিকে হাঁটব, আরও আধুনিক হব, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করব। এটাই যদি নীতি হয়ে থাকে, তাহলে আগ বাড়িয়ে এ কথা কেন বলতে যাব যে ঐকমত্য থাকলেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে? প্রগল্ভতার তো একটা সীমা আছে। আগে এ ধরনের একটি উক্তি করে সিইসি কি প্রকারান্তরে প্রতারণা করেননি? আমি শতভাগ নিশ্চিত যে শাসক দল যদি বলে ইভিএম চাই না, তাহলে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে এক মুহূর্ত দেরি হবে না।

বিএনপির দাবি শুনে মনে হতে পারে, ইভিএমের বদলে ব্যালট পেপার ব্যবহার হলেই বুঝি নির্বাচন ভালো হবে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অতীতে অনেক নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত না হলেও বিএনপি তাকে সুষ্ঠু বলে সার্টিফিকেট দেয়নি।

সিটি নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের দোলাচলে আছেন অনেকেই। বিএনপি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তারা অংশ নিচ্ছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে, আবারও প্রমাণ করতে যে এই কমিশনের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপি যা খুশি তা ভাবতে পারে। কমিশনকে চাপে রাখার জন্য রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় এ ধরনের কথা বলে থাকেন। সিইসি কিছুদিন আগে বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনে দলের পক্ষে প্রচারে নামতে পারবেন না, এমনকি ‘সমন্বয়ের’ কাজও করতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, এতে করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকছে না। কেননা, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তো ঠিকই তাঁদের দলের লোকদের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন। তোফায়েল আহমেদ বিষয়টির গভীরে যেতে চাননি। কোনো ‘সরকারি’ পদে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালালে নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। কারণ, ওই পদের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা অনেক। বিএনপির নেতারা কোনো সরকারি পদে নেই। পদ হারালে যে ক্ষমতা থাকে না, তা তোফায়েল আহমেদের চেয়ে ভালো আর কে বুঝবেন?

প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে সহিংসতা হবে কি না। ইদানীং এর আলামত দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে কমিশন তা বাতিল করতে পারে। এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা হয়েছে কম-বেশি, বিশেষ করে বরিশালে। বরিশালের নির্বাচন তদারকির দায়িত্বে ছিলেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব প্রার্থী বা তাদের দল তাঁকে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি নিজে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বিষয়টি কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ ওই দিন তিনি নির্বাচন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে পারতেন। তা হলে তিনি ‘অমর’ হতেন কিংবা ‘শহীদের’ মর্যাদা পেতেন। তিনি তা করেননি। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন কোথায় থামতে হবে। ক্ষমতা থাকলেও ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস সবার সব সময় হয় না। ওটাও তো একটা চাকরি। নিয়োগকর্তাকে চটানোর কী দরকার। কোনো ‘মিরাকল’ না ঘটলে ঢাকার দুই অংশে বিরোধী দলের মেয়রকে নিয়ে সরকার ‘মুজিব বর্ষ’ কিংবা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে না। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]