হলোকাস্ট স্মরণ: আধুনিক হলোকাস্টের কী হবে?

ফিলিস্তিনে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছবি: এএফপি

২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের খোস্ত শহরের কাছাকাছি এলাকা। মার্কিন প্রিডেটর ড্রোন বৃত্তাকারে চক্কর দিচ্ছে আকাশে। সিআইএর কাছে তথ্য ছিল, সেখানে আল–কায়েদার ওসামা বিন লাদেন বা অন্য বড় কোনো জঙ্গিনেতা ছিলেন। লক্ষ্যকে নিশানা করে ড্রোন থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। হামলার পর সিআইএ বুঝতে পারে যে ভুল হয়েছে। ওসামা বিন লাদেন বা অন্য কোনো জঙ্গিনেতা সেখানে ছিলেন না। ছিলেন বেশ কিছু সাধারণ নাগরিক। কেউ নিত্যদিনের মতো জঙ্গল দিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। কিছু লোক ভাঙা জিনিসপত্র সংগ্রহ করছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরুর পর এ রকম ভুল মার্কিনরা অহরহ করেছে। আর সন্ত্রাসীদের দায় লাখো বেসামরিক মানুষ বেঘোরে জীবন দিয়ে শোধ করেছে।

পরবর্তী বছরগুলোয় পাকতিয়া প্রদেশে আরও ১ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল বলে এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে, মধ্যপ্রাচ্যসহ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানেই ৮ লাখের বেশি বেসামরিক মানুষকে মার্কিনরা হত্যা করেছে জঙ্গি, আল–কায়েদা ও তালেবান দমন করতে গিয়ে। মার্কিনদের হামলা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, কিছুই রেহাই পায়নি। জঙ্গলে কাঠকুড়ানির দল, খেলার মাঠে শিশু, খেতে কাজ করতে থাকা কৃষক, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্স—কেউই বাদ যাননি যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবৃষ্টি থেকে। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেছে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। বিভিন্ন আনুমানিক হিসাবের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে সংখ্যাটা যে নেহাত কম না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর ভিটেছাড়া হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ।

পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, লিবিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস দমনের নামে পাকতিয়ার মতো বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছেন বিশ্বের যুদ্ধবাজ নেতারা। আজ ইসরায়েল মারছে তো কালকে আমেরিকা। সিরিয়ায় তুরস্ক মারছে, ইয়েমেনে সৌদি আরব। একজন সন্ত্রাসীকে মারতে গিয়ে বোমা ফেলে, মিসাইল ছুড়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে শত শত জনপদ। কখনো ভুল করে মিসাইল ছুড়েছে। কখনো ভুল করে ক্লাস্টার বোমা মেরেছে। প্রাণঘাতী অস্ত্রের কথা বলে ইরাককে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিরিয়াতেও দোজখ তৈরি করেছে মার্কিনরা। এরপর যোগ দিয়েছে রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক। সিরিয়ায় সব পক্ষই বেসামরিক মানুষ মারছে। আর ফিলিস্তিনের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ইসরায়েলিরা পাখির মতো ফিলিস্তিনিদের শিকার করে চলেছে। গাজায় মারছে, রামাল্লায়, পশ্চিম তীরেও।

যুদ্ধবাজ নেতারা যেন সারা বিশ্বকেই এখন হলোকাস্টে পরিণত করেছেন। এখন হরদমই হলোকাস্ট সংঘটিত হয়। বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। গতকাল (সোমবার) ছিল হলোকাস্ট স্মৃতি দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনী আজ থেকে ৭৫ বছর আগে পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে আউশভিৎস-বিরকেনাউ বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর আগে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে জার্মানির নাৎসি বাহিনী। নিহত লোকজনের অধিকাংশই ছিল ইহুদি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে বন্দী করা হয়েছিল। গ্যাস চেম্বারের জন্য কুখ্যাত হচ্ছে আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের ক্যাম্প। একসঙ্গে বহু মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দিত নাৎসিরা। সেই গ্যাস চেম্বারের ভেতর ঢুকে দেখে এসেছি। ভেতরে প্রবেশের পর মনে হলো সব যেন থমকে আসছে। লাখ লাখ ভয়ার্ত মানুষের কান্না, আর্তচিৎকার এখনো যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গ্যাস চেম্বারের দেয়ালে। সেখানে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। মনে হয় সভ্যতাকে বিদ্রূপ করেছে গ্যাস চেম্বারে দগ্ধ হওয়া দুর্ভাগারা। সভ্যতার ইতিহাসের এক বর্বরতম ঘটনা সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।

বিবিসি জানিয়েছে, হলোকাস্ট দিবসকে ঘিরে আউশভিৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে উপস্থিত হয়েছিলেন অনেকেই। এসেছিলেন বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হওয়া ইহুদিরাও। ইহুদিদের কেউ কেউ আবার এসেছিলেন ইসরায়েল থেকে। তঁদের অনেকেই এখনো বহন করছেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীকালীন ভয়াবহ স্মৃতি। কারও কারও দেহে আছে নির্যাতনের চিহ্নও। কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাস হচ্ছে আউশভিৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতিতদের অনেকেই এখন অন্যের দেশ জবরদখল করে নিজের দেশ বানিয়েছেন। গোটা ফিলিস্তিনকেই আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করেছে ইসরায়েল।

ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কার্যত ইহুদিদের ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করা হয়। জার্মান নাৎসিদের নির্যাতনের পাশাপাশি বিজয়ী শক্তিও কৌশলে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে পুনর্বাসন করে দেয়। যদিও অনেক দিন ধরেই জায়নবাদীরা ইহুদিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করছিল। কিন্তু সময় দায় শোধ করার জন্য আলগোছে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সিরিয়া, ইরাকের যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ উদ্বাস্তু জার্মানিতে এসে যেন ইহুদিদেরই শূন্যস্থান পূরণ করছে। এক জাতিকে প্রথমে মেরেধরে শায়েস্তা করা হয়। পরে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়াও যায়। অন্য আরেক জাতি প্রায় ৬০-৭০ বছর পর এসে আবার দাঁড়াচ্ছে পুরোনো ভূমিকায়। কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, ইহুদি ও আরব উভয় জাতিই যুদ্ধের শিকার। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে আরব-কুর্দি নিধনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যুদ্ধের নায়কেরা কিন্তু একই। সেই ইঙ্গ-মার্কিন মিত্র জোট। রাশিয়াও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আছে। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিনদের সঙ্গে নেই। পরিস্থিতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই। বার্লিন দখলের মতোই কে কার আগে সিরিয়া দখল করবে, সেই লড়াইয়ে মত্ত।

সবাই আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের নির্মমতা অনুভব করে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া নির্মমতাও অনুধাবন করতে হবে। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইহুদিদের রক্ষা করতে না পারায় ডাচ সরকারের ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে ১ লাখের বেশি ইহুদিকে আটক করে আউশভিৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করা হয়। আরও অনেকেই বিভিন্ন সময় দুঃখ প্রকাশ করেছেন, লজ্জিত হয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধের নামে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হলো, এর জন্য কি পশ্চিমের যুদ্ধবাজ নেতাদের বিচার হবে? এই সময়ে আর কোনো গ্যাস চেম্বারের প্রয়োজন নেই। ড্রোন আছে পরাশক্তিদের হাতে। মুহূর্তে মিশিয়ে দিতে পারে পাকতিয়ার মতো যেকোনো জনপদ। ধরে-বেঁধে ক্যাম্পে আনার প্রয়োজন হয় না। বরং খুনিরাই পৌঁছে যায় জায়গামতো।

পশ্চিমা নাগরিকেরা যখন আউশভিৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জড়ো হয়ে অতীতের গ্লানির জন্য যাতনা বোধ করছেন, তখনো ইবলিদ, আলেপ্পোতে বেসামরিক মানুষকে মারা হচ্ছে নির্বিচারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পশ্চিমারা কি সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে বেসামরিক লোক হত্যার জন্য সমান যাতনা ও গ্লানি বোধ করেন? শতাব্দীর যুদ্ধবাজ নেতাদের কি যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে? এর জন্য পশ্চিমারা ক্ষমা চাইবেন, লজ্জিত হবেন?

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক