মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র আঁকছে রাশিয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিমা জোটের উদারনৈতিক অর্থনীতি আর পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে সোভিয়েত জোটের আদর্শিক কর্মপন্থা লাতিন আমেরিকা ও মধ্য এশিয়ায় সুফল দিলেও মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, যে প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ ছিল আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ। আফগান যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। কিন্তু মার্কিনদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পরে আদর্শিক পররাষ্ট্রনীতির স্থান নিয়েছে স্বার্থভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি। এদিকে সিরীয় যুদ্ধের অনিশ্চিত গতিপথ রাশিয়াকে আবার ফিরিয়ে এনেছে মধ্যপ্রাচ্যে। সেই গতিপথ আরও নির্বিঘ্ন করেছে সাম্প্রতিক তুরস্কের তথা ন্যাটোর আকাশসীমায় রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০-এর উপস্থিতি, কাতার অবরোধ, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ইরানে মার্কিনদের সম্ভাব্য আগ্রাসন।

ইরাক যুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে বিরোধিতার কারণ ছিল সাদ্দাম হোসেনসহ তাঁর সহযোগীদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার কাছাকাছি অবস্থান। কিন্তু তৎকালীন রাশিয়া সোভিয়েত-উত্তর ধকল থেকে উত্তরণে মনোযোগী থাকায় হাত গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। হালের সেই রাশিয়া সোভিয়েতের শেষ যুগের ছত্রভঙ্গের খোলস ভেঙে বিশ্বরাজনীতিতে বেশ তৎপর। ইউক্রেন, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া এবং সর্বশেষ লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় রাশিয়া একটি পক্ষ। এভাবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন দাপট তৈরি হয়েছে পুতিনের রাশিয়ার। তবে নিন্দুকেরা রাশিয়ার এই শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের পেছনে ট্রাম্প ও ওবামার অনির্ভরযোগ্য পররাষ্ট্রনীতিকেই দুষছেন। আর সেই নীতি খোলাসা করেছেন ওবামা আমলের পেন্টাগনের সিনিয়র কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু এক্সাম। কংগ্রেসে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অ্যান্ড্রু ২০১৫ সালে ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে আসাদ সরকারকে রক্ষার জন্য ওবামা প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করেছিল বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আদতে অ্যান্ড্রুর স্বীকারোক্তি মোতাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিই রাশিয়ার নবজন্মকে ত্বরান্বিত করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতিতে রাশিয়ার আগমন সেই অটোমানদের স্বর্ণযুগ থেকেই। রাশিয়া অটোমানদের সঙ্গে ডজন খানেকেরও বেশি যুদ্ধে জড়িয়েছে। বিশেষত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার আর্মেনীয়দের পক্ষ নেওয়া থেকে তৈরি হওয়া অবিশ্বাস কখনোই মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্ককে মজবুত করেনি। বলশেভিক বিপ্লব-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন রাশিয়ার অবস্থানকে ভিত্তি দেওয়া শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিসরের গামাল আবদুল নাসের, সিরিয়ার হাফেজ আল-আসাদ আর ইরাকে বাথ পার্টির কল্যাণে রাশিয়া এসব দেশের কাছাকাছি হয়। সোভিয়েত সাহায্যে নাসের সুয়েজ খালের দখল নিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে চমক দেখিয়েছিলেন, তা আজও মিসরের প্রতিটি মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তবে আদর্শগত জায়গা থেকে বের হয়ে রাশিয়া এখন তার পরিধি বিস্তৃত করেছে ইরান আর তুরস্কে।

তবে আরব বিশ্বে রুশবিরোধী মনোভাবের মূলে ছিল সোভিয়েতের আফগানিস্থান আক্রমণ। এর কল্যাণেই মার্কিনরা স্নায়ুযুদ্ধের পুরোটা সময় আরবদের সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পেরেছিল। আফগান যুদ্ধ পুরো মুসলিম বিশ্বকে সোভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তাই সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া কখনোই আক্ষরিক অর্থে আরবদের সঙ্গে মীমাংসায় যেতে পারেনি সিরিয়া যুদ্ধের আগপর্যন্ত।

সিরিয়ার যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হিসাব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়াকে চমৎকারভাবেই ফিরিয়ে এনেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে ওবামা-ট্রাম্পের নৈরাজ্যপূর্ণ সিরীয় নীতি, পুরোনো বন্ধু আসাদ পরিবারকে মস্কোর সহযোগিতা আর আরব বসন্তে বাতাসে ভর করেই। শুরু থেকেই সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো কর্মপন্থা ছিল না, যা ছিল মিসর ও তিউনিসিয়ায়। সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থার অনুপস্থিতি সিরীয় যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে নানান কিসিমের খেলোয়াড়কে যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনে—বিশেষভাবে তুরস্ক, ফ্রান্স, জার্মানি আর রাশিয়াকে। ওয়াশিংটনের এই দুর্বলতার সুযোগে আসাদ তাঁর বাবা হাফেজ আল-আসাদের স্নায়ুযুদ্ধকালীন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সহযোগিতায় মস্কোকে দামেস্কের সুরক্ষায় রাজি করান।

মার্কিনদের ব্যর্থতা, আঙ্কারার ন্যাটোবহির্ভূত পররাষ্ট্রনীতি আর সিরিয়ার যুদ্ধে পুতিনের একক ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি সৌদি বলয়েও রাশিয়াকে নতুন মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করে। সেই সুবিধা নিয়েই সোভিয়েত আমলের আদর্শিক নীতি থেকে সরে এসে, মস্কোর মুনাফানির্ভর নীতি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দুই বলয়েই প্রভাব বিস্তার করেছে। আর মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সামরিক শক্তি কুর্দিদের একাংশ তো সোভিয়েত আমল থেকেই মস্কোর পাশে। মোটাদাগে এখন মস্কোর বীণেই মধ্যপ্রাচ্য নাচছে।

মস্কোর এই শক্তিশালী অবস্থান আর আমিরাতের দূতিয়ালিতে প্রথা ভেঙে প্রথম সৌদি কোনো বাদশাহ ২০১৭ সালে মস্কো পৌঁছান। পুতিনের সঙ্গে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়, সৌদিরা রাশিয়ার জাতীয় বিনিয়োগ ব্যাংকে, অবকাঠামোয় বিনিয়োগে সম্মত হয়। বিনিময়ে সিরিয়ায় ও মধ্যপ্রাচ্যে তেহরান ও আঙ্কারার ভূমিকার সীমাবদ্ধতা চায় সৌদিরা। সৌদির পেট্রো ডলার অনেকটা সফলও হয়েছে এই কাজে। সমালোচকেরা বলেন, আমিরাত আর সৌদির অনুরোধেই মস্কো তেহরানের কাছে আজ পর্যন্ত এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বিক্রি করা থেকে বিরত রয়েছে।

তুরস্কের মতো দেশ ওয়াশিংটনের নীতিতে আস্থা হারিয়ে মস্কোমুখী দীর্ঘদিন থেকেই। সিরীয় যুদ্ধে কুর্দিদের সমর্থন দিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে নামানো ও ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে পরোক্ষ মার্কিন সম্মতি তুরস্ককে রুশ বলয়ে নিয়ে গেছে। আঙ্কারা মার্কিন নীতির জবাব দিয়েছে ন্যাটোর আকাশে রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ মোতায়েন করে। আর সৌদি বলয় যখন কাতার অবরোধ করে, তখন ওয়াশিংটনের ভূমিকা দোহাকে অসন্তুষ্ট করে। দোহা নীরবতা বজায় রেখেই নিরাপত্তার জন্য মস্কোমুখী হয়। দোহা এখন মস্কো থেকে এস-৪০০ ক্রয়ের পেছনে ছুটছে, যা হাতে পেলে আঞ্চলিক রাজনীতির কাঠামো বদলে যেতে পারে।

ইরাক, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি গঠন করেছে রাশিয়া। তবে এই বিনিয়োগ আরও বেশি লোভনীয় হয়েছে যখন পুতিন অনেকটা সিরিয়ার মতো করেই নিরাপত্তার আশ্বাসও দিচ্ছেন। লিবিয়ার হাফতারকে সৈন্য আর বন্দুক দিয়ে রাশিয়া সঙ্গ দেওয়ার কারণ, হাফতারের দখলে রয়েছে লিবিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রায় ৭৫ শতাংশ। একইভাবে ইরাকে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আর সরকারকে নিরাপত্তা দেওয়ার চুক্তিতে রাশিয়া পেয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্র পশ্চিম আল কুরনা থেকে পেট্রল রপ্তানির অনুমতি। রাষ্ট্রের বাইরেও রাশিয়া সোভিয়েত আমলের বন্ধুদের নতুন করে আবিষ্কার করে কদর করছে, পিকেকে তাদের অন্যতম। কুর্দিদের একটি অংশ, পিকেকে, ইয়েপেগের হাতিয়ারের অন্যতম জোগানদাতা রাশিয়া—ডলারের হিসাবে যা বার্ষিক ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন।

১০০ বছর আগে ব্রিটিশরা মধ্যপ্রাচ্যে থেকে আরবদের সহযোগিতায় অটোমানদের বিদায় করে বর্তমান মানচিত্রের জন্ম ঘটিয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পুরোটা সময় সেই মানচিত্র রাশিয়াকে ভোগালেও আজ তারা এর সুবিধা নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়া শুধু ফিরেই আসেনি, মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মানচিত্র অঙ্কন করছে মস্কো। সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দি রাষ্ট্র, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরানের অনুগত শিয়া রাষ্ট্র হবে সেই মানচিত্রের নতুন বাস্তবতা।

রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত লেখক