আমাদের কান এবং নগর পরিষ্কার করবেন তো?

সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে ব্যাপক প্রচার চলছে। পোস্টারে ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে। গানে গানে আমাদের কর্ণকুহরে তীব্র গানজট। পরিবেশবিদেরা চিন্তিত। পোস্টারগুলো লেমিনেট করা। এগুলো তো পরিবেশসম্মতভাবে ডিজপোজ করা যাবে না। যদি শুধু কাগজ হতো, এগুলো রিসাইকেল করা যেত। এগুলো যদি শুধু পলিথিন বা প্লাস্টিকের তৈরি হতো, তাহলেও রিসাইকেল করা যেত। এখন কাগজ আর পলিথিন একসঙ্গে, এগুলো করা হবে কী? আর এত গান আর বাজনা কেন? নগরবাসীর কানে মধু না বর্ষণ না করে যন্ত্রসংগীতের যন্ত্রণা কেন করা হচ্ছে? 

আমরা পরিবেশবিদ নই। আমরা আমজনতা। আমরা খুব খুশি। বেশ ভালো লাগছে। একটু নবাব নবাব বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। প্রার্থীরা আমাদের কাছে ভোট চাইছেন। আমাদের দাম দিচ্ছেন। আগামীকাল ভোটের দিন। আমরা এই সময়ই তো রাজা। তারপর যে প্রজা ছিলাম, আবার সেই প্রজাতেই পরিণত হব।

এ বিষয়ে কোনো কৌতুক মনে পড়ছে না। যা মনে পড়ছে, তা-ই বলে নিই।

এক ইঁদুর লাফাচ্ছে। বনের রাজা সিংহের মেয়ের বিয়ে। আমারও দাওয়াত। বনের রাজা সিংহের মেয়ের বিয়ে।

বনের রাজা সিংহের মেয়ের বিয়ে। তাহলে তুই ইঁদুর লাফাচ্ছিস কেন? তোর কী?

আরে আমিও তো বিয়ের আগে সিংহই ছিলাম। বিয়ের পর না আমি ইঁদুর হয়ে গেছি।

একদিন এক মেয়র পদপ্রার্থী গেলেন নির্বাচনী প্রচার সভায়। এলাকার লোকজনকে বললেন, আপনাদের সমস্যা কী?

স্থানীয় মুরব্বি বললেন, ‘আমাদের দুটো সমস্যা। এক. আমাদের একটা হাসপাতাল আছে। কিন্তু সেখানে কোনো ডাক্তার নাই।’

আচ্ছা। ‘আমি এখনই হেলথের ডিজিকে বলে দিচ্ছি।’ তিনি মোবাইল বের করলেন। ‘হ্যালো ডিজি সাহেব, অমুক জায়গায় হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নাই। সামনের মাস থেকে এখানে ডাক্তার চাই। হ্যাঁ হ্যাঁ। দিতেই হবে। থ্যাংক ইউ।’
‘আপনাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। সামনের মাস থেকে ডাক্তার আসবে এখানে।’ দুই নম্বর সমস্যা কী?

দুই নম্বর সমস্যা হলো, আমাদের এলাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। দেখেন কারও হাতে কোনো মোবাইল নেই।

মেয়র নিয়ে একটা গল্প আছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের। আমি এটা একবার অনুবাদ করে এই কলামে ছাপিয়েছিলাম। কিন্তু মহাজন লেখকদের গল্প বারবার পড়া যায়।

একজন ডিগ্রিহীন ডেন্টিস্ট সকালবেলা তাঁর চেম্বার খুলে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করছেন। এ সময় ফোন বাজল, ডেন্টিস্টের ছেলে ফোন ধরল। তারপর এসে ডেন্টিস্টকে বলল, ‘বাবা, মেয়র ফোন করেছেন, তিনি জানতে চান তুমি কি চেম্বারে আছ?’
ডেন্টিস্ট বললেন, ‘নাই। বলে দাও, নাই।’

ছেলেটা গেল এবং ফিরে এসে বলল, ‘মেয়র জিজ্ঞেস করছেন, তিনি কি এখন আসতে পারেন?’
‘বলে দাও, আমি নাই।’

‘তিনি তোমার সব কথা ফোনে শুনতে পাচ্ছেন।’
‘গিয়ে বলো, দেখা হবে না।’

একটু পরে ছেলে এসে বলল, ‘বাবা, উনি বলেছেন, তুমি যদি তাঁকে না দেখো, তিনি তোমাকে গুলি করে মারবেন।’
এবার ডেন্টিস্ট তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তাঁকে আসতে বলো।’

মেয়র এলেন। ডেন্টিস্টের চেয়ারে চিত হয়ে শুলেন। হাঁ করলেন। ডেন্টিস্ট দেখলেন, একটা আক্কেলদাঁতের অবস্থা খারাপ। বললেন, ‘দাঁতটা তুলে ফেলতে হবে।’
মেয়র বললেন, ‘তুলে ফেলুন।’

ডেন্টিস্ট বললেন, ‘কিন্তু কোনো অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা যাবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ, ওখানে পুঁজ হয়ে গেছে। রাজি?’
‘হ্যাঁ। তুলে ফেলুন।’
এবার ডেন্টিস্ট মেয়রের পা বাঁধলেন। হাত বাঁধলেন। বললেন, ‘হাঁ করুন।’ সাঁড়াশিটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাদের কুড়িজনকে হত্যা করেছেন গুলি করে। এবার তার মূল্য আপনাকে দিতে হবে।’ তিনি দাঁতটা টেনে তুলে ফেললেন।
মেয়রের চোখে পানি চলে এসেছে। ডেন্টিস্ট তাঁকে একটা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বললেন, ‘চোখের পানি মুছে ফেলুন।’
যাওয়ার সময় মেয়র বললেন, ‘বিলটা পাঠিয়ে দেবেন।’
‘বিল কার নামে পাঠাব? আপনার ব্যক্তিগত নামে, না সিটি করপোরেশনের নামে?’
মেয়র বললেন, ‘দুইটা তো একই।’
আমাদের মেয়ররা এই রকম নন। তাঁরা ভালো। আমরা ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হককে ভুলিনি।
আমরা নতুন মেয়রের কাছে কী চাই?

নতুন মেয়রের কাছে কিছু চাই না। যাঁরা মেয়র পদপ্রার্থী, তাঁদের কাছে চাই। নির্বাচনের পর এই যে কয়েক হাজার ট্রাক পোস্টার বর্জ্য জমবে, তা অপসারণের কাজে দয়া করে অংশ নেবেন।

তবে আমাদের কানের মধ্যে যে জঞ্জাল জমছে, তা কী করে আমরা দূর করতে পারি?

আপনারা কি আজই কথা দিতে পারেন, ঢাকায় যে একটা আন্তর্জাতিক উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর বসত, তা আয়োজনের জন্য একটা ভেন্যু আপনারা জোগাড় করে দেবেন? আমরা একটু চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনে কানটা এবং মনটা পরিস্রুত করতে চাই।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক