কর্মের ফল বনাম তকদির বা ভাগ্য

তকদির বা ভাগ্যে বিশ্বাস ইসলামের প্রাথমিক সপ্ত বিশ্বাসের অন্যতম। তকদির শব্দের আভিধানিক অর্থ মুকাদ্দার বা নির্ধারিত। তকদির শব্দটি কখনো কখনো সিদ্ধান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি বস্তুতে সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহ নির্ধারিত প্রকৃতি প্রদত্ত তার নিজস্ব কিছু গুণ, ক্ষমতা ও সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণাগুণকে ‘কদর’ বলা হয়। কদর অর্থ ভাগ্য, অর্থাৎ যা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কদর মানে নির্ধারিত অর্থাৎ যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটি মূলত কোনো বস্তুর সম্ভাবনা বোঝায়। যাকে ‘পদার্থের ধর্ম’ বলা যায়। ‘কদর’ বা সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হলো ‘আমল’ বা কর্ম এবং কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে ‘নিয়ত’ বা ইচ্ছা। মানবসমাজে কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ হয়। আল্লাহ তাআলা নিয়ত বা ইচ্ছা অনুযায়ী ফল বা প্রতিদান দিয়ে থাকেন।

কখনো কখনো দেখা যায় বস্তু তার নিজ কদর বা ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না বা করে না, তখন তাকে বলা হয় ‘কাযা’। কাযা অর্থ সিদ্ধান্ত, আল্লাহ তাআলার ফয়সালা। ‘কাযা’ কখনো ‘কদর’–এর অনুকূলে হয়, আবার কখনো কদরের প্রতিকূলে হয়। কাযা যখন কদরের অনুকূলে হয়, তখন তা আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু কাযা যখন কদরের বিপরীত হয়, তখন তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

সব বস্তুর স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। মানুষের কর্মের স্রষ্টাও আল্লাহ তাআলাই, কিন্তু মানুষ আপন কর্মের ফায়িল বা কর্তা। পার্থক্য হলো ‘আল্লাহ তাআলা হলেন কাজের খালিক বা স্রষ্টা, আর মানুষ হলো সে কাজের ফায়িল বা কর্তা’। সুতরাং একদিকে মানুষ যেমন মুখতারে কুল বা সম্পূর্ণ স্বাধীনও নয়, অন্যদিকে মানুষ তেমনি মাজবুরে মাহায বা সম্পূর্ণ অক্ষমও নয়। এতে ‘আদলে ইলাহি’ বা আল্লাহ তাআলার ন্যায়বিচার ও আল্লাহ তাআলার ‘আদল’ বা ‘আদিল’ ন্যায়বিচারক হওয়াও বহাল থাকে।

আল্লাহ তাআলা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছু জানেন, একে বলা হয় ইলমে ইলাহি বা আল্লাহ তাআলার জ্ঞান। এই ইলমে ইলাহি বা আল্লাহ তাআলার জ্ঞান সব সময় কাযা বা সিদ্ধান্ত অর্থাৎ তকদির বা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নয়। এটা কখনো কখনো আমল বা কর্ম। অর্থাৎ মানুষের জীবনে যা কিছু সংঘটিত হয় তা দুই ভাগে বিভক্ত: আমল বা কর্ম এবং কাযা বা সিদ্ধান্ত অর্থাৎ তকদির বা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকট রয়েছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃজঠরে রয়েছে। কেহ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেহ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে অবহিত।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ৩৪)। শাঈখ তাকীয়ুদ্দীন নাবাহানী (রহ.) বলেছেন: যা স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে করা হয়, তা হলো আমল বা কর্ম, এর জন্য পুরস্কার বা তিরস্কার আছে, আর যা অনিচ্ছায়, অজান্তে বা প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত হয়, তা হলো আল্লাহ তাআলার ফয়সালা, যাকে আমরা তকদির বলি, এতে কোনো পাপ–পুণ্য নেই। যেমন প্রথমত, কোনো বিশেষ এলাকায় জন্ম হওয়া, লম্বা হওয়া বা খাটো হওয়া, ফরসা হওয়া বা শ্যামলা হওয়া ইত্যাদি, এতে কোনো পাপ–পুণ্য নেই। দ্বিতীয়ত, সম্ভাবনা বা কদর বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জেনেশুনে ভালো বা মন্দ নিয়ত নিয়ে কোনো কাজ করা বা না করা ইত্যাদি হলো আমল বা কর্ম, এর জন্য পুরস্কার বা তিরস্কার রয়েছে।

তকদির বা ভাগ্যকে মুসলিম দার্শনিকেরা দুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: মুবরাম ও মুআল্লাক। মুবরাম অর্থ স্থিরকৃত, মুআল্লাক অর্থ পরিবর্তনীয়। আল্লাহ তাআলা ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, তিনি পরিবর্তন করারও ক্ষমতা রাখেন। তকদির বা ভাগ্য নেক আমল দ্বারা, পিতা-মাতার দোয়ায় ও সদকা ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবর্তন হয়। তকদির বা ভাগ্য মানুষের অজানা অজ্ঞেয় ও অজেয়; আমরা জানি না তা স্থির নাকি পরিবর্তনীয়। সুতরাং আমাদের উচিত হলো আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা, আল্লাহর রহমত চাওয়া ও এমন নেক আমল করা, যার মাধ্যমে আল্লাহ তুষ্ট হয়ে আমাদের তকদিরকে সৌভাগ্যে পরিণত করবেন। কর্মই ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক, তাই সৎকর্ম বা নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]