সাবেক সচিবেরা কী চান

দেশকে ভালোবাসা, দশজনের জন্য ভালো কিছু করার উদ্যোগকে সর্বদাই স্বাগত। কিন্তু দেশ ও সরকার তো সমার্থক নয়। বরং রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। উপায় ও প্রক্রিয়া নিয়ে মতভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের একটি চিঠির অংশবিশেষ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এর বিষয়বস্তুর সঙ্গে দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি আধা সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান হিসেবে সচিব মোর্চা করার উদ্যোগটি নেওয়া আদৌ যৌক্তিক হয়েছে কি না। এ নিয়ে জনমনে ভুল–বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের সঙ্গে অনেকে একমত হবেন যে এখানে নৈতিকতার প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে কথা বলেছি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনিও তাতে সায় দিলেন। তবে বড় বিষয় হলো, জনমনে ধারণা কী হবে। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন। বিএনপিকে চাপ দিতে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এটা অবশ্যই বিএনপির প্রাপ্য। কিন্তু এই দুর্নীতিটা প্রধানত সরকারি খাতের এবং সরকারি কর্মকর্তারাই প্রধানত এর কুশীলব। বিশ্বের দেশে দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক দলকে
লুটপাটের জন্য দায়ী করা হয়, তখন আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে দেশটির বেসামরিক কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে জড়িত। কারণ, সরকারি কর্মকর্তাদের ছাড়া সরকারি খাতসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি করা যায় না। বর্তমান সরকারের আমলেও ‘চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতার’ কিছু সচিব বা সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। দুর্নীতি দমনে বর্তমান সরকারের সাফল্য সন্তোষজনক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়া থেকে দূরে রয়েছে।

সরকারের ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে কাজ করতে চান অবসরপ্রাপ্ত সচিবেরা। বহু দেশে এটা আপনা-আপনি ধরে নেওয়া হয় না যে শীর্ষ কর্মকর্তা যাঁরা হন, তাঁরাই সৎ। কারণ, শীর্ষ পদে আহরণের মানদণ্ড প্রধানত মেধা ও যোগ্যতা। তাঁরা সবাই সততার দিক দিয়ে উচ্চমানের তেমনটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই। আলী ইমাম মজুমদার আরেকটি প্রশ্ন তুলেছেন, সব সাবেক সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়নি। তাঁর দাবি, এতে পরিষ্কার যে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই সভা করা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে আপাতত বিরত থাকতে চাই, কারণ, কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অবশ্য এটি কোনো সাধারণ নীতির ভিত্তিতে নেওয়া সাধারণ উদ্যোগ নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। এই ঘটনার মূল উদ্বেগের কারণ হচ্ছে দুদকের প্রধান এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছেন এবং সে কারণেই কথাটা তোলার অবকাশ তৈরি হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে সচিবদের ‘পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান’ করার যুক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কয়েকজন সাবেক সচিব দাবি করেছেন, যাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরাই উপস্থিত ছিলেন।

এখন পর্যন্ত আমরা আমেরিকান স্পয়েল সিস্টেম চালু করার পক্ষে সততার সঙ্গে অবস্থান নিতে পারিনি। স্পয়েল সিস্টেমের সততার দিকটি হলো, যার যা আদর্শ, সেটা ধারণ ও প্রকাশ করেই ব্যক্তি তার কর্মজীবনকে পরিচালনা করতে পারে। লুকোছাপার ব্যাপার নেই। এই মুহূর্তে ডেমোক্র্যাট সমর্থক, যাঁরা ভবিষ্যতে প্রশাসনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষমাণ। মেধাবীরা নিজেদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্যতর করে গড়ার চেষ্টায় সতত নিয়োজিত। বর্তমানে গোটা প্রশাসনে ট্রাম্পের মনোনীতরা দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি চলে গেলে গোটা প্রশাসন প্রায় রাতারাতি রিপাবলিকান থেকে ডেমোক্র্যাটে পরিণত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় ‘একই আদর্শে বিশ্বাসী’রা প্রস্তুত বা সক্রিয় থাকছেন, তাকে কোনো সিস্টেমে ফেলা চলে না।

বাংলাদেশের রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনা এবং যেখানেও ‘একই আদর্শে বিশ্বাসীদের’ মধ্যে রক্তক্ষরণ দেখছি। কারণ, অধিকতর মেধাবী ও যোগ্যরা দলের ভেতরেই শক্তিশালী তদবির ও অন্যান্য নানা বিবেচনায় পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। সেই বিবেচনায় ৪২ সাবেক সচিবের সম্ভাব্য থিংক ট্যাংকটি কার্যত একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যেও যাঁরা সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন বা সচিব হতে পেরেছেন, তাঁদের থিংক ট্যাংক।

 প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের উঁচু ও দায়িত্বশীল পদগুলোতে ওই ‘সমমনাদের’ নিয়োগ বা মনোনয়ন চলছে। তবে আলী ইমাম মজুমদারের একটি প্রশ্নের পিঠে কেউ পাল্টা প্রশ্ন তুলতে পারেন। বলতে পারেন, অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের একটি স্বনির্বাচিত অংশের থিংক ট্যাংক গঠন তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তাঁরা কাকে ডাকবেন, কাকে ডাকবেন না, সেটা তাঁদের ব্যাপার। কিন্তু আলী ইমাম মজুমদারের প্রশ্নটা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না এই কারণে যে সভাটি ডেকেছেন দুদক চেয়ারম্যান এবং তাঁকে তো নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। তিনি কোনো দলীয় পদে নেই। সংবিধিবদ্ধ পদাধিকারী। বিশেষ করে দুদকে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা নিজেদের দলনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি সুরক্ষায় বিশেষভাবে সংবেদনশীল থাকবেন। সেই বিবেচনায় এই চিঠি একটি বিচ্যুতি। দেশ ও দশের স্বার্থে সরকারের ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা দুদকের সনদ সমর্থন করে না।

যেসব পদধারীদের বিচারপতিদের মতো প্রক্রিয়ায় অপসারণযোগ্য বলে সংসদ আইনের দ্বারা ঘোষণা দিয়েছে, তাদের জন্য একটি মৌলিক আচরণবিধি প্রণয়নের পক্ষে আমরা দীর্ঘদিন ধরে লিখে আসছি। আলাদা করে তেমন কিছু যেহেতু নেই, তাই বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য বিধিকেই দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রযোজ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এতে বলা আছে, ব্যক্তি তার নিজের স্বার্থে তার প্রতিষ্ঠানের সুমহান মর্যাদাকে অবনমিত করবেন না।

 মহীউদ্দীন খান আলমগীর যে যুক্তিতে ‘জনতার মঞ্চ’ করেছিলেন, সেটা কিন্তু সাধারণ নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। জনতার মঞ্চ করার কারণে তাঁর প্রতি যে ব্যক্তিগত ঋণ তা শোধ করার অনেক আয়োজন হয়েছে। কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত পাদপ্রদীপে রাখা যায়নি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সরকারের থিংক ট্যাংক লাগবে কেন? সাবেক সচিবেরা পুনর্মিলনী করবেন, পিকনিক করবেন, জ্ঞানচর্চা করবেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে থিংক ট্যাংক কেন? নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ঘাটতি পড়লে মন্ত্রণালয় বা সংস্থাগুলোর হাত খোলা। তারা যে কাউকে আউটসোর্সিংয়ের দায়িত্ব দিতে পারে।

সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় যদি প্রস্তাবিত সংগঠনের বিকাশ ঘটে, তাহলে তার একটি সাধারণ নীতি দরকার। কারণ, এটা জনপ্রশাসনে বিভিন্ন ক্যাডারদের মধ্যে ভুল বার্তা দিতে পারে। পুলিশ বিভাগ কিছুদিন আগে বলেছে, তারাই সরকার পরিচালনার নিয়ন্তা। দুদক চেয়ারম্যানের চিঠির বিবরণে যা বলা হয়েছে, তার একটা সাধারণ গ্রাহ্যতা রয়েছে। যেমন ‘আপনার রয়েছে চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতার পটভূমি। এসবের মিথস্ক্রিয়ায় আপনি ধীরে ধীরে হয়েছেন ঋদ্ধ, পরিণত ও প্রাজ্ঞ।’ এ রকম বক্তব্য আরও অনেক ক্যাডার ও পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অবসরে যাওয়া সব পেশাজীবী কি তাহলে থিংক ট্যাংক করতে এগিয়ে আসবেন? চিঠিতে ‘দেশ ও জাতি এগিয়ে’ যেতে ‘সবার ইতিবাচক সম্মিলিত প্রয়াসের’ কথা বলা হয়েছে। এই ‘সবার’ মানে কি প্রশাসন ক্যাডারের সচিবেরা? সবচেয়ে বড় কথা হলো, চিঠিতে যোগ্যতা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও সততা ও প্রশাসনে ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।

একজন প্রবীণ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গেই স্মরণ করলেন যে পাকিস্তান আমলে সিএসপিরা বলতেন, বিভিন্ন সেবা খাতের প্রধান হিসেবে সিএসপিই জরুরি, কারণ সিএসপির ভাষা সিএসপিই ভালো বুঝতে পারেন। সে কারণে শিল্পাঞ্চল কর্তৃপক্ষের প্রশাসক পদে সিএসপিদের দেখা গেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সিএসপিদের শ্রেষ্ঠত্ব টেকসই উন্নয়ন দিতে পারেনি। কারণ, সিএসপিরা স্বচ্ছতাবান্ধব ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতিতে নয়, ক্ষমতার একত্রীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। আমাদের ৪২ সচিবও অনেকখানি সিএসপি-নীতি দ্বারা আচ্ছন্ন। অবসরজীবনেও স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রসেবক তাঁরা হতে চান না, তাঁরা সরকারসেবক হতেই সংকল্পবদ্ধ হতে চাইছেন।

তবে প্রতীয়মান হয় যে দুদক চেয়ারম্যানের চিঠি শুধু সাবেক সচিবেরা নন, আরও অনেক ক্যাডার ও পেশার মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করবেন। স্মরণে আনবেন নানা আখ্যান, মিল-অমিল খুঁজতে নজর দেবেন ইতিহাসে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]