দুই সিটি করপোরেশন

অন্য সব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নির্বাচনের পর সরকারি দলের পক্ষ থেকে ‘অতীতের যেকোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চেয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে সরকারি দল আচরণবিধি ভঙ্গ ও জবরদস্তি করেছে। তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে এই নির্বাচনও বিতর্কের মুখে পড়েছে।

যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো সেটি কেবল অংশগ্রহণমূলক হলেই হবে না, প্রতিযোগিতামূলকও হতে হবে।
প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল ও প্রার্থীর সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। এ বিষয়ে শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশন চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু সাংবিধানিক
এই প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো পদাধিকারীর কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তাঁরাই জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছেন। নির্বাচনী প্রচারে আচরণবিধি ভঙ্গের অজস্র প্রমাণ ও অভিযোগ থাকলেও তাঁরা আমলে নেননি।

মানুষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্বাচন কমিশন কেউ সে ধরনের শিক্ষা নিতে প্রস্তুত আছে বলে মনে হয় না। এ কারণে দেখা যাচ্ছে আগের নির্বাচনের তুলনায় পরের নির্বাচনটি ক্রমাগত খারাপই হচ্ছে। ২০১৫-এর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জবরদস্তির কারণে বিরোধী দলের প্রার্থীরা দুপুর ১২টার মধ্যে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে নির্বাচনটি হয়ে পড়েছিল একতরফা। এবারের নির্বাচনের দিন দৃশ্যমান জবরদস্তির মাত্রা কম হলেও ইভিএমের মাধ্যমে কারসাজি ও এই পদ্ধতিকে সরকারি দলের স্বার্থে ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ এসেছে।

 পাঁচ বছর আগের দুই সিটি নির্বাচন ও পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণে সিটি নির্বাচন নিয়ে যে নগরবাসী আগ্রহ হারিয়েছেন, তা স্পষ্ট। তদুপরি নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই যেভাবে নির্বাচনটি পরিচালনা করেছে, তাতে তাঁরা আরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এটি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অসম রাজনৈতিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কোনো দলের কাছেই যে নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তার প্রমাণ শেষ মুহূর্তে ইশতেহার প্রকাশ। ভোটারের স্বল্প উপস্থিতি প্রমাণ করে, নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা ও অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। এটি কোনোভাবে গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নেবে না। বরং আমাদের নড়বড়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও ভঙ্গুরই করে তুলবে।

 ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার রেশও সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যে বিরোধী দল বিএনপি আজ ১২ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে। তাদের হরতাল কর্মসূচি সফল না বিফল হবে, সেই প্রশ্নের চেয়েও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো দেশে আবার হরতাল ডাকা হলো। হরতাল শুধু জনজীবনই ব্যাহত করে না, অর্থনীতিকেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সিইসি বলেছেন, ভোট পড়ার হার ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। স্বৈরাচারী এরশাদের বিদায়ের পর অংশগ্রহণমূলক কোনো নির্বাচনে এত কম ভোট পড়ার নজির নেই (উপনির্বাচন বাদে)। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা ও অনীহাই প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী, বিরোধী দল যদি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে, তাহলে সরকারি দল কেন ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে পারল না?