'শত বছরের সেরা' নির্বাচন ও কাকের গল্প

ডিএসসিসি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় ছিল এমন সুনসান। ছবি: প্রথম আলো
ডিএসসিসি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় ছিল এমন সুনসান। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে এক ধরনের হিসাব ছিল। নির্বাচনের পর আরেক ধরনের হিসাব। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষায়। উত্তরে আতিকুল ইসলাম ৯ মাসের অনুশীলন শেষে জনসেবায় পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করবেন। নির্বাচনী প্রচারে তেমনটিই বলেছিলেন। দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস মেয়র হিসেবে নতুন হলেও ১১ বছর জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি উন্নত ও আধুনিক ঢাকা গড়ার কাজ শুরু করবেন প্রথম দিনে থেকেই।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচন বানচাল ও প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা প্রতিটি কেন্দ্রে ৫০০ সশস্ত্র ক্যাডার আনার পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিএনপির সব ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা ব্যর্থ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ দুই মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে। ঢাকা তাদেরই দখলে থেকে যাচ্ছে। এ বিজয়কে খাটো করে দেখার উপায় কী!

অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, নির্বাচনে হারলেও তারা লাভবান হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতা-কর্মীরা মাসখানেক ধরে সক্রিয় ছিলেন। নেতা-কর্মীদের পালিয়ে বেড়াতে হয়নি। এটি তাদের প্রথম লাভ। দ্বিতীয় লাভ এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। লাভের ফল ঘরে তুলতে এক দিন তারা হরতালও পালন করেছে।

তবে নির্বাচনের পর ‘ইত্তেফাক’ চমৎকার একটি শিরোনাম করেছে: ‘আওয়ামী লীগের ভোটাররাই গেল কই’। তাপস-আতিকের প্রচারণায় বিপুল লোকসমাগম থাকলেও ভোটের দিন তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী যেখানেই গেছেন, আমরা দেখেছি তাঁদের পেছনে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক। তাঁরা ভোট দিলেও নৌকা প্রতীকে ৩০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, আওয়ামী লীগের মিছিলে থাকা কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিএনপির লোকজনও ছিলেন। যদি সেটি না হবে, তাহলে কেন্দ্রে ভোটারের আকাল কেন হলো?

পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা স্লোগান দিতে দিতে মানুষের ঘুম নষ্ট করেছেন। পোস্টারে পোস্টারে ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছেন। এমনকি ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। কিন্তু ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা মোট ভোটারের মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। উত্তরে আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ ভোট। আর দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির তাবিথ আউয়াল ২ লাখ ৪২ হাজার ৮৪১ ও ইশরাক হোসেন ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫১২ ভোট পেয়েছেন কেন্দ্রে কোনো এজেন্ট-সমর্থক না পাঠিয়েই।

নব্বই-পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৩ শতাংশের কম ভোট পায়নি। এমনকি ২০০১ সালে তাদের ভূমিধস পরাজয়ের সময়ও আওয়ামী লীগ ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর যখন সারা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, তখনই তাদের প্রার্থীর বাক্সে ভোটের খরা।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তাঁকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। তিনি কত শতাংশ ভোট পেলেন, সেটি বিবেচ্য নয়। সে ক্ষেত্রে ১৫ কেন ৫ শতাংশের কম ভোট পেলেও আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হতেন। সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কেননা ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব বিরোধী দলই বর্জন করেছিল। এরশাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমান। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিদেশে চাকরি দিয়েছিলেন। আর এরশাদ তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে আবার ভোট নেওয়া হয়। এখানে সেই ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তাতে ভোটের হার ৫৫ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯১, ১৯৯৬ (১২ জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথা বলা যায়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও ভোটারের উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬০ শতাংশ, ২০১৭ সালে পৌরসভা নির্বাচনে ৭৪ শতাংশ, ২০১৮ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে ৫৭ শতাংশ থেকে ৭৮ শতাংশ। আর এবারে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, উত্তরে ২৫ দশমিক ৩ ও দক্ষিণে ২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। বাস্তব দৃশ্য অবশ্য বলে ভিন্ন কথা।

সিটি নির্বাচনে কম ভোট পড়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা যেসব কারণ দেখিয়েছে, সেটি মেনে নিলে বিএনপিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল হিসেবে মেনে নিতে হয়। তাঁরা বলেছেন, বিএনপির নেতিবাচক প্রচারের কারণে ভোটার কম এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় বিএনপি চাইলে কেন্দ্রে ভোটার বেশি আসেন, আর না চাইলে ভোটারের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা একদিকে বলেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, অন্যদিকে দাবি করছেন, তাদের জন্যই ভোটারের উপস্থিতি কম হয়েছে। কোনটি সত্য? যদি বিএনপির জনপ্রিয়তা না-ই থাকবে তাহলে কীভাবে তারা ভোটারদের প্রভাবিত করল?

নির্বাচনের আগে তিন দিন ছুটি থাকায় ঢাকার অনেক মানুষ নাকি গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এ রকম কথাবার্তা বলেছেন তাঁরা। ভোটের আগে তিন দিন ছুটি ছিল না। ছুটি ছিল এক দিন। সরস্বতীপূজায় সরকারি অফিস আদালত খোলাই ছিল। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র কিংবা আশপাশের এলাকায় যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা ঢাকারই বাসিন্দা হলেও ভোটার গ্রামের। ১ ফেব্রুয়ারি গ্রামের ভোটাররা ঢাকায় ছিলেন আর ঢাকার ভোটাররা গ্রামে বেড়াতে গেছেন, এই আজগুবি তথ্য কেউ বিশ্বাস করেন না।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাবার্তা শুনে নাসিরউদ্দিন হোজ্জার সেই বহুল কথিত কাকের গল্প মনে পড়ল। একজন হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলুন তো এই শহরে কত কাক আছে?’ তিনি বললেন, ‘৯ হাজার ৯৯৯টি।’ এরপর গুনে দেখা গেল তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। তখন নাসিরউদ্দিন হোজ্জা বললেন, ‘যদি কাকের সংখ্যা বেশি হয় বুঝতে হবে অন্য কোথাও থেকে কাকেরা এখানে বেড়াতে এসেছে। আর যদি কম হয় তাহলে বুঝতে হবে এখান থেকে তারা অন্য কোনো শহরে বেড়াতে গেছে।’

সিটি নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও। ভোট শেষ হওয়ার পর সিইসি হাসিমাখা মুখে বলেছেন, ভোটারের উপস্থিতি ৩০ শতাংশের কম। তবে দুর্মুখেরা বলেন, গত বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হলে ভোটারের উপস্থিতি ৮০ শতাংশ হতো না বা দেখানো যেত না—২০ শতাংশের কম হতো। গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম-১২ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ২৩ শতাংশেরও কম।

সিটি নির্বাচনের আগে বিএনপির অতি বিচক্ষণ নেতারা তাঁদের সমস্ত শক্তি ও বাক্য ব্যয় করেছেন ইভিএমের পেছনে। ইভিএম কত খারাপ সেটি প্রমাণের জন্য তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ইভিএম-ই তাদের ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছে। ইভিএমের কারণে নির্বাচন কমিশন অন্তত দিনের ভোট রাতে করতে পারেনি। ২০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্র না এলেও ৮০ শতাংশ দেখাতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনে গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ (উত্তরে ২৫.৩ ও দক্ষিণে ২৯ শতাংশ) ভোট পড়ে থাকলে ৭৩ শতাংশ ভোটার এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাঁরা ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

যে নির্বাচনে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোটার গরহাজির থাকেন, সেই নির্বাচনকেই আওয়ামী লীগ নেতারা শত বছরের সেরা নির্বাচন বলে দাবি করেছেন। এর চেয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর কী হতে পারে?

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
[email protected]