বিএনপি একা কী করবে?

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হরতালের সমর্থনে কর্মসূচিতে অংশ নেন ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী ইশরাক হোসেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হরতালের সমর্থনে কর্মসূচিতে অংশ নেন ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী ইশরাক হোসেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সব দায়িত্ব বিএনপির। বিএনপি ভোটের মাঠেও পারছে না, মাঠের রাজনীতিতেও পারছে না। আন্দোলনে জনগণকে টেনে আনতেও পারছে না। বিএনপি না হয় খুবই ছন্নছাড়া সময় পার করছে। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। কিছুই করতে পারছে না। কিন্তু দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার পুনঃস্থাপনের দায়িত্ব কি একমাত্র বিএনপির। অন্যরা কী করছে? অন্যরাও তো কিছুই করতে পারছে না। তাহলে বিএনপিকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?

বিএনপিকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মূল কারণ হচ্ছে বিএনপি দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের অনেক জনসমর্থনও আছে। কিন্তু এই জনসমর্থনকে কাজে লাগিয়ে দলটি মাঠের রাজনীতিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। বরং বিএনপির কিছু কিছু আচরণ যথেষ্ট হাস্যরসের সৃষ্টি করছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক দোষারোপ ও দায়িত্ব বর্তানোর প্রবণতা দেখা যায়। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন ও গত কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন প্রমাণ করে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আগের রাতেই ভোট হয়ে যাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যা বলেন, সেটাই শেষ কথা বলে মেনে নিতে হয়। অনেকের মৃত আত্মীয়স্বজন এসে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। এক নির্বাচনে কোনো কেন্দ্র শতভাগের বেশি ভোট পড়ছে। আবার আরেক নির্বাচনে ৭০ শতাংশের বেশি ভোটারই কেন্দ্রে আসছেন না। নির্বাচনপদ্ধতি ধসে গেলে সেই দেশে গণতন্ত্রের আর কিছুই বাকি থাকে না। দেশে এখন নির্বাচনপদ্ধতি ধসে যাওয়ার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রকারান্তরে বলেই দিয়েছেন, প্রতিরোধ করার শক্তি নিয়ে নির্বাচনে নামতে হয়। যদিও এটা কোনো স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে না। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

পরিত্রাণের পথ খুঁজতেই বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি আঙুল তুলছে বিএনপির অনেক সমর্থকসহ বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। বিএনপির মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, গণমানুষ পথে নেমে ভোটের অধিকার স্থাপন করবে। এরপর একটি নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু গণমানুষ কার ভরসায় পথে নামবে। বিএনপি কি সেই আস্থা অর্জন করতে পেরেছে? এ কথা সত্য যে, দমন-পীড়নে দলটি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হাজারো নেতা-কর্মী হয় জেলে, নয়তো ফেরারি। অনেক নেতা-কর্মী রাজধানীতে এসে পাঠাও-উবারের গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মোট কথা, বিএনপি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই পুলিশ ৩০ মিনিট সময়ে দিলেও ৩ মিনিটেই ভেগে যাচ্ছে বিএনপি।

অপর দিকে দেশের সাধারণ মানুষ হয়তো মনে মনে ধারণা করছেন, বিএনপি তাদের বিশাল জনসমর্থন নিয়ে দেশে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। সেই আন্দোলনের তোড়ে সব অন্যায়-অনিয়ম ভেসে যাবে। দেশের মানুষের ভোটাধিকার আবারও প্রতিষ্ঠিত হবে। ভোটাররা তাঁদের পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। দেশে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। ত্বকী, তনুদের লাশ নদীর তীর, ঝোপঝাড় থেকে উদ্ধার করা হবে না। স্বামী হত্যার দুঃস্বপ্ন এসে আয়েষা সিদ্দিকা মিন্নির ঘুমে হানা দেবে না। বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অপরাধের রাতে দল বেঁধে এসে সরকারি দলের ক্যাডাররা গণধর্ষণ করবেন না। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবে না। ভয়ংকর এক আতঙ্কময় দিনের অবসান হবে।

কিন্তু সাধারণ মানুষ ও বিএনপির এই প্রত্যাশা একবিন্দুতে এসে মিলছে না। স্কুলের বাচ্চারা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য রাজপথ কাঁপালেও বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের দায়িত্ব নিতে পারছে না। কারণ একটি দল হিসেবে যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকার কথা, বিএনপির মধ্যে সেই আচরণগুলোই নেই। রাজনৈতিক আচরণ ও বিচারবুদ্ধিতে পরিপক্বতার পরিচয় দিতে পারছে না বিএনপি। বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীর প্রত্যাশার বোঝা বহনের সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব বিএনপিতে ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত। ঠিক কখন কোথায় কোন দানটি চালতে হবে, খেলার বোর্ডে বসে বিএনপি তা বেমালুম ভুলে বসে আছে। এর পরিণাম যেমন বিএনপিকে ভোগ করতে হচ্ছে, তেমনি দেশের জনসাধারণকেও।

বিএনপি ও জনগণের বোঝাপড়ার এই দূরত্ব গভীর রাজনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। শুধু বিএনপিই না, অন্যসব রাজনৈতিক দলের প্রতিও জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম। বিএনপির প্রতি না হয় বিরক্ত হয়ে ভোটকেন্দ্রে আসছে না। কিন্তু ৭০ ভাগেরও বেশি ভোটার তো নীরবে অনাস্থা জানিয়ে দিয়েছেন সরকারের প্রতিও। তাঁদের ডাকেও তো সাড়া দিচ্ছে না মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায়িত্ব দেশের নাগরিকেরা নিতে ইচ্ছুক না। নাগরিকের রাজনীতিবিমুখতা নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ব্যাহত হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ঢঙে ভোট হবে। দেশে স্বেচ্ছাচারিতার বিকাশ ঘটবে আরও। রাজনীতি, রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক অনাস্থার সম্পর্কই আজকের সংকট।

বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ: নিষ্ফল জেনেও কেন তারা নির্বাচনে যায়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, দল ধরে রাখার জন্যই নির্বাচনে, সংসদে যাওয়া। কিন্তু এরপরও কি দল ধরে রাখা যাচ্ছে? অনেকে নেতা-কর্মী জেল-জুলুমের পর দলে নিষ্ক্রিয়। অনেকেই নিজ নিজ ব্যবসার সুবিধার্থে রাজনীতি থেকে অবসরে গেছেন। এভাবে চললে বিএনপিকেই রাজনীতি থেকে অবসরে চলে যেতে হবে।

কিন্তু এরপর কী হবে? গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়ে সবাই ফল পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন। কিন্তু বিএনপি তো একা পারছে না। অন্যরা কোথায়? বিএনপিকে একা দোষারোপ করে তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক