একটি সুরতহাল রিপোর্ট

সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এল মহাসমারোহে। পথঘাট ছেয়ে গেল ব্যানারে-পোস্টারে। কয়েকটা দিন ছিল গানবাজনায় ভরপুর। কিন্তু বক্স অফিস হিট হলো না। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোটার মুখ ফিরিয়ে থাকলেন। ভোট দিতে গেলেন না। যাঁরা গেলেন, তাঁরা ফিরে এলেন মিশ্র অভিজ্ঞতা নিয়ে। কারও কাছে এটা কমেডি, কারও কাছে ট্র্যাজেডি। এ নিয়ে বাড়ি, অফিস, চায়ের দোকান আর গলির মোড়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া চলছে। কদিন পর সব থিতিয়ে আসবে। নতুন কোনো উপলক্ষ তৈরি হতে দেরি হবে না। তখন আমরা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ব।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করা যাক। আগেই বায়না করা ছিল, কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বয়ান করব। সকাল সকাল ভোট দেওয়ার ইচ্ছেটা মুলতবি রেখে ছুটলাম এক চ্যানেলে। সেখানে সঙ্গী পেলাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে। তিনি সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং আমার একজন পছন্দের মানুষ। এর পরপর যে চ্যানেলে নসিহত করতে যাব, দেখলাম সেখানেও তিনি আমার সহযাত্রী হবেন। কাকতালীয় ব্যাপার।

যাওয়ার পথে সোজা পথে না গিয়ে তিনি একটু ঘুরপথে যেতে চাইলেন। উদ্দেশ্য, কয়েকটা ভোটকেন্দ্র দেখা। পথে কয়েকটা কেন্দ্র পড়ল। সব জায়গায় একই ছবি। একটি দলের লোকজন গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁটাহাঁটি করছেন। কেন্দ্রের গেটের সামনে তাঁদের জটলা। আশপাশে তাঁদের টেন্ট। ভোটদাতাদের সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে আছেন। অন্য কোনো দলের হদিস নেই। যেতে যেতে গাড়িচালক জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। সকাল সকাল ভোট দিয়েছেন তিনি। বললেন, মেশিনে আঙুলের ছাপ দিয়েছেন। এরপর ইভিএমে বোতাম টিপবেন। তো পেছন থেকে একজন গিয়ে ওই বোতাম টিপে দিলেন। বললাম, ভাই এটা কী করলেন? আমার ভোট আপনি কেন দিলেন? তিনি বললেন, ‘অসুবিধা নাই। এবার আমি আঙুলের ছাপ দিচ্ছি। আপনি গিয়ে ভোট দিয়ে আসুন।’ বুঝলাম, আঙুলের ছাপ ছাড়া ভোট হবে না। এখানে কারসাজির সুযোগ নেই। যিনি আঙুলের ছাপ দিয়েছেন, তিনি ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত হলেন মাত্র। দ্বিতীয় পর্বে অন্য কেউ তাঁর কাজটি করে দিলেও তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। অর্থাৎ প্রথম ধাপে ভোটের হাজিরা বাধ্যতামূলক। তবে দ্বিতীয় ধাপে প্রক্সি দেওয়া চলে। পরপর দুটি চ্যানেলে ঘুরে একটু ক্লান্তি এল। বাসায় ফেরার পথে ভাবলাম ভোটটা দিয়ে দিই। কে নগরপাল হবেন, এটা নিয়ে আমার তেমন কোনো টেনশন নেই। দুজনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ঢাকা তিলোত্তমা হবে। আমার আগ্রহ, ইভিএম জিনিসটা কেমন, এটা কীভাবে কাজ করে, তা একটু পরখ করে দেখা।

এর আগে জেনে নিয়েছিলাম আমার ভোটকেন্দ্র কোনটি। নিয়ম অনুযায়ী মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে পেয়ে গেলাম দরকারি তথ্য। ভোটকেন্দ্রের নাম, ভোটার নম্বর, এমনকি আমার সিরিয়াল নম্বর। চমৎকার ব্যবস্থা। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে হচ্ছে, এটি তার লক্ষণ। আমি চমৎকৃত হলাম। নির্বাচন কমিশন এ জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে।

সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠলাম। এখানেও একই ছবি। একটি দলের লোকেরা ঘুরঘুর করছেন। নির্দিষ্ট কামরায় ঢুকে দেখলাম, একজন বসে আছেন। সামনে একটা মেশিন। বুঝলাম ইনিই পোলিং কর্মকর্তা। কামরায় আট-দশজন তরুণ। গলায় একটি দলের ব্যাজ ঝোলানো। মনে হয় চেহারা দেখে আমাকে চিনতে পেরেছেন। সমস্বরে বলে উঠলেন মুরব্বিকে ভোট দিতে দেন। বেশ তমিজের সঙ্গেই আমাকে স্বাগত জানালেন তাঁরা। মেশিনে বুড়ো আঙুল ছোঁয়ালাম। স্ক্রিনে আমার এনআইডি কার্ডের ছবি দেখা গেল। কামরার ভেতরেই কালো কাপড়ে ঘেরা একটা জায়গা। ওখানে গিয়ে কী করতে হবে, আমাকে বুঝিয়ে দিলেন পোলিং কর্মকর্তা। বুঝতে বেগ পেতে হলো না। উপস্থিত তরুণদের একজন আমাকে সাহায্য করার জন্য পিছু পিছু এলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, এখন আর স্বেচ্ছাসেবকের দরকার নেই। কালো কাপড়ে ঢাকা জায়গায় পাশাপাশি তিনটা মেশিন। সমস্যা হলো নারী আসনে কাকে ভোট দেব। কাউকে চিনি না। মার্কা দেখে বোঝা যায় না কে কোন দলের। হঠাৎ মনে পড়ল, আমার এলাকার রাস্তায় দিনরাত মাইকে গলা ফাটিয়ে জানান দেওয়া হয়েছিল, অমুক আপার মার্কা—তমুক মার্কা। নাম এবং মার্কার কথাটা মনে পড়ল। তাঁকেই দিলাম ভোটটা। তখন বেলা তিনটা। ঘরে ফিরে ঘরওয়ালির কাছে শুনলাম তাঁর অভিজ্ঞতা। তিনি গিয়েছিলেন আরেকটি কেন্দ্রে। কোনো সমস্যা হয়নি। তবে উপস্থিত ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা’ বেশ জ্বালাতন করেছেন। সবাই সাহায্য করতে চান। তিনি তাঁদের রীতিমতো ধমকে দিয়েছেন। তবে তিনি দেখেছেন, বেশ কয়েকজনের ভোট স্বেচ্ছাসেবকেরাই দিয়ে দিয়েছেন।

ভোট বেশি পড়েনি। জয়ী দলের লোকেরা মহা খুশি। ভোটারের উপস্থিতি কম—এটা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনটিই তো হওয়ার কথা। সিটি নির্বাচনে তো সরকার বদল হয় না। ছুটি পেয়ে অনেকেই বাড়ি চলে গেছেন। প্রতিপক্ষ দলের ‘ধমক-ধামক’ খেয়ে অনেকেই ভয়ে আসেননি। এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। সন্তানকে ফেলে মা ভোটকেন্দ্রে আসবেন কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন নেতা বললেন, গত ১০০ বছরে এত ভালো নির্বাচন আর হয়নি। তিনি বোঝাতে চাইলেন, আগের নির্বাচনগুলো খারাপ ছিল।

আমার সরল উপলব্ধি হলো, জয়ী দলের কৌশলটি ছিল অব্যর্থ। এটি কাজে লেগেছে। তাদের হিসাব ছিল, ভোটার যত বেশি আসবে, তাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ততই বাড়বে। তাদের চেষ্টা ছিল যাতে ভোটার উপস্থিতি কম হয়। এ জন্য অনেক ভোটকেন্দ্রের সামনে অহেতুক জটলা তৈরি করা হয়েছিল। গত ডাকসু নির্বাচনে এ কৌশল পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে শুনেছি। এবারও তাই দেখা গেছে। ভোট দেওয়ার পরও তাঁরা অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থেকেছেন। এটাকে বলা হয় ‘বুথ ক্যাপচার’। পুরোপুরি অহিংস। 

হেরে যাওয়া দলটি বুঝতে পারেনি প্রতিপক্ষের কৌশল। অথবা বুঝলেও গা-ছাড়া ভাব দেখিয়েছে। ভেবেছে, তাদের জেতানোটা আমজনতার নৈতিক দায়িত্ব। আমার প্রশ্ন, তারা দল বেঁধে ভোটকেন্দ্রে কেন গেল না। আমি অনেক কট্টর সমর্থককে জানি, যাঁরা সারা দিন ঘরে বসে ছিলেন। গেলে কী হতো? হাতাহাতি-মারামারি? ছয়জন না দশজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁরা কোনো দলের ক্যাডার নন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। দলের জন্য ভোট দিতে গিয়ে দলের কয়জন মার খেয়েছেন, হাসপাতালে গেছেন—এ প্রশ্ন থেকেই যাবে।

হেরে গিয়ে তাঁরা হরতাল ডেকেছেন। অতিব্যবহারে অস্ত্রটি এখন পুরোপুরি অচল। যাঁরা বাড়িভাড়া দিয়ে খান বা চাঁদাবাজি করে দিন গুজরান করেন, হরতালে তাঁদের তেমন ক্ষতি হয় না। অন্যদের তো কাজ করে খেতে হয়। তাঁরা কেন হরতাল করবেন? কে হারল আর কে জিতল, এ ভাবনায় গলদঘর্ম হয়ে তাঁরা ঘরে বসে থাকবেন কেন? 

হরতাল সফল না হওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে নির্বাচনটি সাফসুতরো হয়েছে। এটা একধরনের ‘অ্যাপ্যাথি’। মানুষ এই ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারও জয়-পরাজয়ে তাদের লাফালাফি কিংবা কান্নাকাটি করার ইচ্ছাটা মরে গেছে।

বড় দুই দলের চার মেয়র প্রার্থীকেই আমার ‘প্রেজেন্টেবল’ মনে হয়েছে। তাঁরা শিক্ষিত, সজ্জন। তাঁরা কেউ গুন্ডা-মাস্তান নন। বিশেষ করে পরাজিত দুই মেয়র প্রার্থী তাঁদের দলের সম্পদ হতে পারবেন। তাঁরা হলেন উদীয়মান তারকা। তবে তাঁদের ওপরে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছেন অনেকেই, যাঁরা এঁদের উঠতে দেবেন না। তা না হলে তড়িঘড়ি করে হরতালের মতো একটা বস্তাপচা ঘোষণা তাঁরা দিতেন না। অন্য কোনো সৃজনশীল পথ খুঁজতেন। লোক হাসানোর এই পথ ছাড়া তাঁরা কি আর কিছু ভাবতে পারেন না?

আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, ইভিএম একটি ভালো প্রযুক্তি। এটি আরও উন্নত করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থায় পোলিং এজেন্টের দরকারই পড়ে না। ভোটকেন্দ্রে থাকবেন শুধু নির্বাচনী কর্মকর্তারা। ভোটাররা একজন করে ঢুকবেন এবং ভোট দেওয়ার পর সেখানে আর থাকবেন না। এটি নিশ্চিত করতে পারলে ভোট ভালো হবে। আমাদের সমস্যা অন্য জায়গায়। নির্বাচন কমিশনাররা দৃঢ়চেতা নন। তাঁরা মনে হয় চাকরি করছেন। ‘নিয়োগকর্তার’ মন জয় করাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। আর রাজনৈতিক দলের কাছে ভোটযুদ্ধ হলো চর দখলের লড়াই।

ইভিএম হলো একটা ছুরির মতো। ডাক্তারের হাতে পড়লে এটি অস্ত্রোপচারে কাজে লাগে। কসাইয়ের হাতে পড়লে মুণ্ডু কাটা পড়তে পারে। মেশিনের কী দোষ? 

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক