মেহেদী ও হাজেরার স্বপ্নে শরৎচন্দ্র

নতুন বইয়ের জায়গা করতে হবে। গত সপ্তাহে তাকগুলো থেকে বিদায় দেওয়ার মতো বই বাছতে বসে মেহেদীর কথা মনে পড়ল।

মেহেদীর সঙ্গে আমার পরিচয় গত ডিসেম্বরে, গৃহকর দিতে গিয়ে। এবার কর দিতে হয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্টের মাধ্যমে, যাকে বলে ডিজিটালি। সেই সূত্রে এলিফ্যান্ট রোডে সুবাস্তু আর্কেড প্লাজায় ব্যাংকটির একটি এজেন্ট-বুথে গিয়েছিলাম।

দোতলায় করিডরের দুপাশে কম্পিউটারের জিনিসপত্রের ছোট-বড় দোকানে স্পিকার ফাটিয়ে গান বাজছে। নানা সুরের জগঝম্প।

ছোট্ট একটি খোপে কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে ছিল কিশোর চেহারার এক তরুণ। তাকে ডিজিটাল হোল্ডিং নম্বর দিলাম। তুরন্ত কাজ হয়ে গেল।

কেমন না কেমন সময় লাগে ভেবে হাতে করে একটা ইংরেজি থ্রিলার নিয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটির চোখ বারবার সেটায় আটকে যাচ্ছিল। উঠতে নেব, ভীরু কুণ্ঠিত গলায় সে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি চাকরি করেন?’ তার কৌতূহল আমার কৌতূহল জাগাল।

কাজের টেবিলে মো. মেহেদী হাসান। ছবি: লেখক
কাজের টেবিলে মো. মেহেদী হাসান। ছবি: লেখক

কেন এ প্রশ্ন? সে বলল, আসলে বয়স্ক কোনো ‘মহিলা’কে এভাবে বই নিয়ে চলাফেরা করতে সে কখনো দেখেনি, তাই। আর এভাবেই মো. মেহেদী হাসানের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো।

বাড়ি তার খুলনা জেলায় সুন্দরবনঘেঁষা একটি গ্রামে। বইটা সমীহের সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে করতে সে বলে, কখনো ইংরেজি বই পড়েনি। আর বলে, শহরে একটু সচ্ছল পরিবেশে বড় হতে পারলে জীবনটা খুলে যাওয়ার কত সুযোগ থাকে!

বাংলা সাহিত্যে বিএ অনার্স পাস করে ঢাকায় এসে ছয় মাস হলো ব্যাংক এজেন্টের এই খোপে টেলারের চাকরি করছে মেহেদী। বারবার বলছিল, ‘আসলে আমি যেখান থেকে উঠে এসেছি...।’

টেলার মেহেদী কম্পিউটারের ইঁদুর ঠুকে মানুষজনের টাকাপয়সা লেনদেনের কাজ করে। বলল, ছাত্রকালে শরৎচন্দ্রের কয়েকটি বই পড়ে সে মুগ্ধ হয়েছে। একদিন ওই লেখকের সব বই জোগাড় করে পড়বে।

মেহেদীকে আরেকটু জানার ইচ্ছা মনে ছিল। কিছু বই দেওয়ার ইচ্ছাও ছিল। সোমবার বিকেলে এলিফ্যান্ট রোডের ভিড় ঠেলে আবার তাই গেলাম তার কাছে।

এবার জানলাম, কিছুদিন আগে খুলনায় গিয়ে সরকারি ব্রজলাল কলেজে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্সের ক্লাসে ভর্তি হয়ে এসেছে সে। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।

মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে ছয় মাসে কিছুই হাতে জমেনি। ঢাকায় নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতে মা-বাবাকে কিছু কিছু করে পাঠিয়েছে আর নিজের ভর্তির টাকাটা দিয়েছে।

এবার টেলারের জীবন শেষ করে মার্চে সে ফিরে যাবে কয়রা উপজেলায় কয়রা নদীর কূলঘেঁষা তার তেঁতুলতলার চর গ্রামে, যেখানে কিনা বিদ্যুৎ গিয়েছে মাত্র গত মাসে আর যেখানকার বেশির ভাগ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা চালায়।

মেহেদীর বাবা নদীতে মাছ ধরেন। জমি আছে ভিটাসহ সাকল্যে এক বিঘার কিছু বেশি। সেখানে ছোট্ট একটি বাগদা চিংড়ির ঘের। সব মিলিয়ে বাবার আয় সামান্য। লোনাপানির দেশে মিঠাপানির হাহাকার, জমিতে ফসল ফলে না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে হাজেরা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে হাজেরা।

পড়া চালাতে হলে তাকে কিছু আয়-রোজগারের উপায় খুঁজতে হবে। একমাত্র ছোট বোনটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। তার স্কুলের ব্যাগ বা নতুন জুতার আব্দারও মেটাতে হবে তো!

মেহেদীর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামে। তারপর কয়রা সদরে ছোট মামার বাসায় থেকে মাধ্যমিক আর পাইকগাছা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা। খুলনা শহরের ডে-নাইট কলেজ থেকে মাসে ৪০০ টাকা বেতন গুনে বিএ অনার্স পাস। অবশেষে ভাগ্য খুঁজতে রাজধানী ঢাকায় আসা।

ঢাকায় তার সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটে ৭০ বর্গফুটের এজেন্ট-বুথে। লালবাগে ছয়তলার এক চিলেকোঠায় তার আস্তানাটি এর চেয়ে একটু বড়। এক কলেজবন্ধু সেটার ভাগীদার।

বুকের মধ্যে মেহেদী নিয়ে এসেছিল মা-বাবা-মার স্বপ্ন—ছেলে একদিন একটা সরকারি চাকরি করবে, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী হবে। আর আছে তার নিজের স্বপ্ন—সাহিত্য পড়া।

মোমের আলোর মতো নরম আলো-জ্বলা চোখে মেহেদী আমাকে বলে, ‘স্কুলে-কলেজে সাহিত্য তেমন পড়া হয়নি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে বুঝলাম, সাহিত্যের যে অসাধারণ পাওয়ার! মানুষকে চিনতে গেলে সাহিত্য জরুরি।... স্বপ্ন দেখি, অনেক স্বপ্ন দেখি ।...’

আর সে আবারও বলে শরৎচন্দ্রের প্রতি তার অনুরাগের কথা। ২৩ বছর বয়সী ছেলেটির কথায় আমার হাজেরা বেগমের কথা মনে পড়ে যায়।

বাংলাদেশের সমান বয়সী হাজেরা বড় হয়েছেন ঢাকার রাস্তায়। পকেটমার দলের সঙ্গে ঘোরা, শিশুকালে গণধর্ষণের শিকার হওয়া, রাস্তা থেকে যৌনপল্লি ঘুরে আবার রাস্তায় শরীর বিক্রি করা—এসবের মধ্যে আরেক আতঙ্ক ছিল পুলিশের ‘ধরা গাড়ি’ আর ‘ফকিরখানার গাড়ি’।

নিয়মিত বিরতিতে ‘ভবঘর’ বা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র অথবা ‘ফকিরখানায়’ থাকার অভিজ্ঞতা ছিল রাস্তার চেয়েও ভীতিপ্রদ। ১৯৮৭ কি ৮৮ সালের বন্যার বছরে শেষবারের মতো আটক হয়ে হাজেরা প্রায় সাত বছর ছিলেন কাশিমপুর আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেই এনজিও কনসার্নের একটা প্রকল্পে প্রথমবারের মতো লিখতে-পড়তে শেখেন।

গত দুই দশকে তিনি আমার বোন হয়ে উঠেছেন। আমার শরৎ রচনাবলি জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ একরকম ভেজে খেয়েছেন। মহেশ, গফুর আর আমেনার গল্প মনে করে এখনো তিনি চোখের পানি ফেলেন। শরৎচন্দ্র তাঁর সর্বকালের প্রিয় লেখক।

হাজেরার পাঠাগারে।
হাজেরার পাঠাগারে।

হাজেরা এখন নিজের এবং সমাজের সহমর্মীদের সহায়তায় রাস্তার যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালান। সেখানে চেয়েচিন্তে আর উপহার পাওয়া বই দিয়ে বড় যত্নে একটি পাঠাগার গড়ছেন।

শরৎপ্রেমী হাজেরার আত্মপরিচয়ে স্বপ্নজয়ের গল্পটা বরং আরেক দিন করব। আজকের মতো শরৎচন্দ্র মেহেদীর। গল্প আর স্বপ্নটাও তারই।

কুররাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
[email protected]