করোনাভাইরাসের বিস্তার: মন্দার ঝুঁকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাস চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ২৪টি দেশে ২০ হাজার ৬৩০ জন মানুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। চীন এ পর্যন্ত ৪২০ জনের বেশি মৃত্যুর খবর দিয়েছে। এটি ২০০২ ও ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে বেশি। তখন চীনের মূল ভূখণ্ডে ৩৪৯ জন মারা যায়। কোনো ওষুধ এখনো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। এ জন্য বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। যদি ভাইরাসটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে বিশ্বের কাছে নিজেকে রক্ষার অল্প কয়েকটি মাত্র উপায় রয়েছে এবং এসব উপায় যদি কাজ না করে, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে করোনাভাইারাসের মহামারি গোটা বিশ্বকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

মহামারিটি বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ২৩ জানুয়ারি থেকে বন্ধ থাকার পর গত সোমবার চীনা বাজারগুলো পুনরায় চালু হয় এবং এর পরপরই দেশটির শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন ঘটে। করোনাভাইরাস মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ধরনকেও পাল্টে দিতে শুরু করেছে। নতুন সংক্রমণের ভয় বিশ্বজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে। অনেক ক্রীড়ানুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লুফথানসা বিমান সংস্থা চীনে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ক্যাথে প্যাসিফিক ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তাদের উড়োজাহাজে বালিশ, কম্বল এবং ম্যাগাজিন বহন বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর কী? 

চীনের সরকারি কর্মকর্তার মতে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির চীন একটি ‘জটিল এবং গুরুতর’ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। দেশটি বছরে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে দেশটির ব্যাপক অবদান রয়েছে। বিমানবন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর চীন কি তার নৌবন্দরগুলোও বন্ধ করে দেবে? এ রকম হলে তা নিঃসন্দেহে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য সরবরাহের চেইনকে ব্যাহত করবে। 

মহামারিটি ইতিমধ্যে আমাদের দেখিয়েছে যে আমাদের আন্তনির্ভরশীল একবিংশ শতাব্দীর অর্থনীতি কতটা দুর্বল। চীন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু এখন করোনাভাইরাসের কারণে পণ্য উৎপাদনে অনেকখানি ভাটা পড়েছে। সরকার ভাইরাসটির বিস্তারকে মোকাবিলার চেষ্টায় চান্দ্র নববর্ষের ছুটি কয়েক দিন বাড়িয়েছিল, কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই; বরং ভাইরাসের বিস্তার আরও বেড়েছে। ইতিমধ্যে প্রাক্–বিদ্যালয়, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে চীনের কারখানাগুলোও আপাতত বন্ধ থাকছে। 

বিখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল ও ফ্রান্সের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পিএসএ খুব দ্রুত বিকল্প সরবরাহকারী সন্ধান করতে শুরু করেছে, যাতে তারা কোনো ক্ষতির মুখে না পড়ে। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই উহানে বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। চীন ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল, খাদ্যসহ যেসব জিনিস উৎপাদন করে, তার ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি করে সমুদ্রপথে। যদি বন্দরগুলো বন্ধ করা হয়, তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটতে পারে। 

মার্কিন অর্থনীতিবিদ স্টিফেন রোচ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই মন্দার মধ্যে রয়েছে। এখন করোনাভাইরাস যদি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তবে বিশ্ব অর্থনীতি আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে। এটা হবে অর্থনীতিকে দুর্বল করার একটি বড় আঘাত। প্রকৃতপক্ষে, অনেক শিল্প ইতিমধ্যে স্থায়ী ক্ষতির প্রত্যাশা করছে যে তারা তাদের ব্যালান্সশিটগুলো মুছে ফেলতে সক্ষম হবে না, এমনকি বেইজিং যদি এই সংকট দ্রুত সমাধান করতেও পারে, তবু অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব হবে ভয়াবহ রকমের নেতিবাচক। উদাহরণস্বরূপ, পর্যটনশিল্প, ট্যুর অপারেটর, হোটেল শিল্প ও বিমান সংস্থাগুলো ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করছে। আগে প্রতিবছর মাত্র কয়েক শ চীনা নাগরিক জাপান ভ্রমণ করতেন। আজ এই সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। থাইল্যান্ড বা ফিলিপাইনের মতো ক্ল্যাসিক পর্যটনস্থলগুলো এখন চীনাদের পছন্দের জায়গা। এ জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেসব দেশ চীনে তাদের রুটের সংখ্যা বাড়িয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে চীনা নাগরিকদের এখন ভ্রমণ করাও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ওই সব দেশের বিমান সংস্থাগুলো যে ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো বিমান সংস্থা যখন বেইজিং এবং সাংহাইয়ের সব ফ্লাইট স্থগিত করে এবং বিশ্বজুড়ে করপোরেশনগুলো যখন ঘোষণা করে যে তারা ব্যবসায়িক ভ্রমণের সংখ্যা হ্রাস করছে, তখন এটি ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সার্সের কারণে শুধু পর্যটনশিল্পের ক্ষতি হয়েছিল এক হাজার কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে নোভেল করোনাভাইরাসটি পর্যটনশিল্পে এর চেয়ে বেশি লোকসান ঘটাবে। 

ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, খুচরা বিক্রেতা ও রাজনীতিবিদেরা এখনো খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে ধারণা করছেন। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে যাঁদের ব্যবসা রয়েছে, তাঁরা এটা বিশ্বাস করছেন যে খুব দ্রুত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল ও আমেরিকান কফি চেইন স্টারবাকস। চীনে স্টারবাকসের ৪ হাজার ৩০০টি আউটলেট রয়েছে, যার অর্ধেকই এখন বন্ধ। 

সব মিলিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, বিশ্ব অর্থনীতি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলার চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করতে হবে।

(স্পিগেল ইন্টারন্যাশনাল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত)

* জর্জ ফারিয়ন, ক্রিস্টিনা জিনিরকে, ভেরোনিকা হ্যাকেনব্রোচ, মার্টিন হেসে, মার্টিন ইউ মুলার, ক্যাথারিনা গ্রাসা পিটারস, মাইকেল সগা ও বার্নহার্ড জ্যান্ড: লেখকেরা জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকার সাংবাদিক