ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সেবাকর্ম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। সরকার ও সংস্থাটির পদে নানা সময় অদলবদল ঘটেছে, কিন্তু অভিযোগ অপরিবর্তিত শুধু নয়, ব্যাপকতাও লাভ করেছে। শুধু রাজউক বলেই নয়, বাংলাদেশের যেসব সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষ যত বেশি নির্ভরশীল, অনিয়ম-দুর্নীতি সেখানে তত বেশি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (িটআইবি) মুখপাত্র বলেছেন, রাজউক ও দুর্নীতি সমার্থক, তেমনটা আরও অনেক সরকারি খাতের সেবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কমবেশি সত্য। ভবন নির্মাণের মতো আরও বহু নির্মাণ রয়েছে, যা শুরু করতে অনুমোদন লাগে। আর এই অনুমোদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয়। রাজউকের ঘুষের অঙ্ক কোটি টাকা পর্যন্ত ওঠার ধারণা অসংগত মনে হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।

তবে টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। কারণ, মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পরে তিনি এমন একটি ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন, যাতে ধরে নেওয়া হয় যে দুর্নীতিবিরোধী একটি অভিযানকে এগিয়ে নিতে তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ রয়েছে। রূপপুরের ‘বালিশ দুর্নীতিতে’ জড়িত ৩৪ কর্মকর্তাবিষয়ক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বড় অগ্রগতি। এক সংবাদ সম্মেলনে গণপূর্তমন্ত্রী বলেছিলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির (বালিশ–কাণ্ড) সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩০ জনই তাঁর মন্ত্রণালয়ের।
এমনকি তিনি গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘আপনারা সোচ্চার হয়েছেন বিধায় এত গভীরে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব
হয়েছে।’ 

ছয় মাসের ব্যবধানে টিআইবির গবেষণা প্রকাশমাত্রই তাৎক্ষণিক তাকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলাটা তঁার আগের অবস্থানের সঙ্গে মেলে না।
অবশ্য আমরা জানি না, তিনি তাঁর সরকারের সমষ্টিগত সাধারণ অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন কি না। সে রকম কিছু হলেও সত্য আড়াল করা কঠিন।

এটা স্মরণযোগ্য যে টিআইবি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই দায়িত্ব পালন করছে। সরকারের অনেক সংস্থার
সঙ্গে নানাভাবে টিআইবি কার্যক্রমের একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে যখনই দেশি–বিদেশি কোনো সংস্থা দুর্নীতি বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তখন তাকে নাকচ করে দেওয়াটা ক্ষমতাসীনদের রুটিন কাজ হয়ে পড়েছে। এটি যে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটেছে তা নয়। বিএনপিও একই রকম প্রতিক্রিয়াদেখাত।

আমরা এ কথা বলছি না যে টিআইবির দেওয়া তথ্যে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে না এবং সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে সঠিক তথ্য উপস্থাপনার সুযোগ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেসব সরকারি সংস্থা, বিশেষ করে ভূমি অফিস, শুল্ক ও কর, দলিল রেজিস্ট্রি, পাসপোর্ট, শিক্ষা ভবন, স্বাস্থ্যসেবার মতো খাত যেখানেই মানুষকে বেশি যেতে হয়, সেখানেই ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতাও বেশি লক্ষ করা যায়। এ ধরনের খাতে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ যদি অনুমাননির্ভর বা ধারণাসূচক–নির্ভরও হয়, সেটাও তদন্ত করে প্রকৃত সত্য জনগণকে জানানো সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য বলে মনে করি।   

রাজউকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তা উত্তরণে ১৪ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। আইনি ও বিধিমালাসংক্রান্ত সংস্কার, ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্যভাবে প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া, ড্যাপ চূড়ান্ত করা এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির আওতায় আনার মতো সুপারিশগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবি রাখে।

 আমরা করব, টিআইবির রাজউক–সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি নিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হবে এবং প্রয়োজনে তারা টিআইবির সহায়তা নেবে। সেবাপ্রতিষ্ঠান নিজের কাজে স্বচ্ছতা না আনতে পারলে এ রকম অভিযোগ আসতেই থাকবে।