জহুরুলের চোখ গেছে, নদী বাঁচাবে কে

বগুড়া
বগুড়া

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের আঘাতে জহুরুলের চোখ থেকে রক্ত ঝরছিল। স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁকে ভ্যানে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অবৈধ বালু–সন্ত্রাসীরা বাধা দিয়ে ভ্যান ফেরত পাঠায়। স্থানীয় জনগণ বিষয়টি থানায় জানান। পরে পুলিশি নিরাপত্তায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে তাঁর চোখের চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে তাঁকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। বালু–সন্ত্রাসীরা তাঁকে এমনভাবে আঘাত করেছে যে তাঁর বাঁ চোখ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এই বালু–সন্ত্রাসীদের কাছে জহুরুলের চোখের চেয়ে বালুর মূল্য অনেক বেশি।

সম্প্রতি জয়পুরহাট গিয়েছিলাম। সেখানে ছোট যমুনা নদীর দুয়ানির ঘাটে অনেকের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নদীর অতীত নিয়ে। অনেকেই বলছিলেন এ নদীতে কয়েক বছর আগেও অনেক বড় বড় নৌকা চলত। নৌপথ হিসেবে এ নদীর সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথাই তাঁরা শোনাচ্ছিলেন। নদীর প্রতি স্থানীয় ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতেই জহুরুল ইসলামের প্রসঙ্গ চলে আসে। এমন সময় জহুরুলও সেখানে উপস্থিত হন। তাঁর কাছেই ঘটনার দিনের ঘটনা জানতে পারি। তিনি দুয়ানির ঘাটে বসে ছিলেন। স্থানীয় জনগণ বালু তুলতে নিষেধ করলেও সেদিন তাঁদের কোনো প্রতিবাদী কর্মসূচি ছিল না। এমনকি সেদিন বালু উত্তোলনকারীদের সঙ্গে কোনো বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়নি। কয়েকজন সন্ত্রাসী এসে তাঁকে উপর্যুপরি মারতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারান। জহুরুলের পাথরের চোখটির দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগছিল। কষ্ট পাওয়া ছাড়া আমাদের আর কীই–বা করার আছে!

ঘটনাটি তিন-চার মাস আগের। জহুরুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। জহুরুল বলেন, সন্ত্রাসীরা তাঁদের নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছে। জহুরুলের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দেলওয়ার হোসেন। দুয়ানির ঘাটে তাঁর ছোট দোকান। তিনি বলেন, শহর থেকে সাংবাদিক এসেছিলেন। তাঁরা কেউ সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে সংবাদ করেননি। দেলওয়ারের ভাষ্য, ‘বড় বড় মানুষ যারা এগুলোর সঙ্গে আছে, তাদের কথা কোনো টিভিও দেখায় নাই।’

জহুরুলের সঙ্গে কথা বলার সময় অনেকে ভিড় করছিলেন। উপস্থিত সবার অভিযোগ ছোট যমুনা নদী থেকে দুয়ানির ঘাটে সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় বালু উত্তোলন করা হয়। দিনদুপুরে অবৈধভাবে চলছিল এ বালু উত্তোলন।

নদীর বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে জহুরুলের একটি চোখ বালু–সন্ত্রাসীদের আঘাতে নষ্ট হলেও বালু–সন্ত্রাসীদের শাস্তি পেতে হয়নি। বোঝাই যায় তাদের খুঁটির জোর কত শক্তিশালী। সুবিচার পাওয়ার আশা জহুরুলেরা ছেড়ে দিয়েছেন। দুয়ানির ঘাটেই একজন বলছিলেন, ‘সুবিচার কেমনে পামো। অত বড় একটা ঘটনা ঘটার পর আসামি জামিন লিয়া আবার হুমকি দিচ্ছে। সুবিচার কোথায় পামো। মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। নইলে একবারে শেষ করি দেবে।’

বালু তোলার প্রতিবাদ করা যাবে না। চোখ তুলে নেবে। মামলাও করা যাবে না? গরিবের শেষ ভরসা আদালত। যাতে আদালতে প্রতিকার না চায়, সে জন্য মামলাই তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। দেশটা তো এখনো মগের মুল্লুক হয়নি। এক চোখ নিয়ে জহুরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমি এখন হতভাগ্যার মধ্যে পইড়া আছি। বিচার কোনো হইচ্ছে না।’

জয়পুরহাটের কোনো নদীই ভালো নেই। গণমাধ্যমকর্মী আলমগীর হোসেনের কাছে জানতে পারি, কয়েক বছর আগে ক্ষেতলাল উপজেলায় তুলসী গঙ্গা নদী খনন করে মাটি দুই পাড়ে ফেলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সূত্রপাত হয়েছে, তা এখনো চলছে। জয়পুরহাটের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শ্রী নদী। নদীটি বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় নদী। জয়পুরহাট সুগার মিলের তরল বর্জ্য এ নদীতে ফেলা হচ্ছে। এ নদীতে পোলট্রি ফার্মের যত ময়লা আছে, সব ফেলা হয়। এসব ময়লা গিয়ে পড়ে ছোট যমুনা নদীতে। এভাবে শ্রী নদী এবং ছোট যমুনা দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ নেই, যিনি দূষণ থেকে নদীটি রক্ষা করবেন। উপজেলা এবং জেলা নদী রক্ষা কমিটিরও কেউ নেই, যিনি নদীর এত বড় সর্বনাশ রোধে এগিয়ে আসতে পারেন।

জয়পুরহাট লাইব্রেরিতে গেলাম সন্ধ্যায়। সেখানে বইয়ের সংখ্যা অনেক থাকলেও পাঠক নেই। যাঁরা আসেন, তাঁরা পত্রিকা পড়েন। বইয়ের পাঠকের বড় অভাব। সেখানে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হক-কথা পত্রিকার সংকলনে খোঁজার চেষ্টা করলাম নদী সম্পর্কে বিস্তর কোনো আলোচনা আছে কি না। সত্তরের দশকের অনেক খবর থাকলেও নদী নিয়ে তেমন কোনো লেখা কিংবা খবর চোখে পড়ল না। শুধু ফারাক্কা নিয়ে একটি লেখা চোখে পড়ল। জয়পুরহাটের নদীকর্মী রবিউল ইসলাম সোহেল বলছিলেন, সত্তরের দশকে তো নদীর এত বড় সর্বনাশ কেউ করেননি। সে জন্য হয়তো নদীবিষয়ক খবর নেই। জয়পুরহাটে নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নদী ঘোরাও নদীর পথে’। তাদের নদী নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। নদী নিয়ে তারা ছোট একটি প্রকাশনাও করেছে। কিন্তু তারা সাহস পাচ্ছে না নদীর সর্বনাশকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।

দেশে কোনো কোনো নদী রক্ষায় স্থানীয় ব্যক্তিরা সংগঠিত হচ্ছেন। নদী রক্ষার জন্য মাঠে নামার অর্থ হচ্ছে ঘুষখোর কর্মকর্তা, পেশিশক্তিধর যারা রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় দানব হয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে নামা। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় স্থানীয় একদল সাধারণ মানুষ চরম সাহসিকতার সঙ্গে দেওনাই নদীর শাখানদী উদ্ধার করেছেন। তাঁরা এখন মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে রাত কাটাচ্ছেন। যাঁরা নদী রক্ষায় এগিয়ে আসবেন, তাঁদের পাশে রাষ্ট্রের দাঁড়ানো উচিত। নদী রক্ষাকারীরা যদি পুরস্কৃত না হয়ে তিরস্কৃত হন, তাহলে নদীকর্মী তৈরি হবে না। জহুরুলের চোখ যারা নষ্ট করেছে, তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, জহুরুল নির্ভয়ে থাকতে পারেন, তাহলে স্থানীয় ব্যক্তিরা সাহসী হবেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নদী রক্ষায় তাগিদ দিচ্ছেন। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের যাঁরা নদীর সর্বনাশ করছেন, তাঁরা তো দলীয় নির্দেশনাও ভাঙছেন। তাঁদের যেমন শাস্তি হওয়ার কথা রাষ্ট্রীয় আইনে, তেমনি দলীয় নির্দেশনা ভাঙার দায়ে দলগত শাস্তিরও বিধান থাকা জরুরি। সর্বোপরি জহুরুলের নিরাপত্তা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]