আমাকে কেন ফরসা হতে হবে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভারতে রং ফরসাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনের জন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখার একটি খবর বের হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই শুনতাম আমার গায়ের রং ময়লা। কিন্তু আদৌ ‘ময়লা’ নামের কোনো রং আছে বলে দেখতাম না। একমাত্র ত্বকের ব্যাপারে ছাড়া এ রকম কথা আর কোনো কিছুর বেলায় শুনতামও না।

‘সুন্দর’ বলতে ত্বকের ফরসা হওয়া বোঝায় এই দেশে। শ্বেতাঙ্গ শাসনের ঔপনিবেশিক মনে সৌন্দর্যের যে ‘রূপ’ গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ছিল শ্বেতাঙ্গ ও আর্যদের ত্বকের মহিমা। ‘সাদা’ শুধু ত্বকের শ্রেষ্ঠত্বই নয়, মঙ্গল, আলো, ভালো—এগুলোর প্রতিশব্দ হয়ে উঠল। বিপরীতে ‘কালো’ মানেই শুধুই ত্বকের বর্ণনা নয়, সেটির ভিন্ন সামাজিক অর্থ তৈরি হলো। যার কারণে কালো বা অ-সাদা হয়ে উঠল ‘অন্ধকার’, ‘ময়লা’, ‘খারাপ’সহ সব নেতিবাচকতার প্রতীক। পুরো বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদী রাজনীতির অন্যতম বড় জায়গা এই ত্বকের রাজনীতি।

পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এই ত্বকের রাজনীতির তাপ সহ্য করতে হয় নারীদের। বিয়ের বাজারে ‘মেয়ের গায়ের রং’ আলাদা সামাজিক ঝালর তৈরি করে। বিয়ের বাজারে নারীর দরের ওঠানামাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে তার গায়ের রং। সামাজিক চাহিদার এই ত্বকীয় রং কোথাও কোথাও ‘যৌতুকের’ পরিমাণ নির্ধারণে রসদ জোগায়। তাই নারীর গায়ের রং ফরসা না হলে তার হেনস্তার পাশাপাশি অভিভাবকের সামাজিক ও মানসিক ঘাম ঝরানো শুরু হয়।

ছোটবেলায় থেকে গায়ের রং ফরসা করার জন্য অনেককেই নানা ধরনের কসরত করতে শুনতাম। কখনো প্রাকৃতিকভাবে এটা-ওটা মেখে, আবার কখনো বিভিন্ন রং ফরসাকারী ক্রিম মেখে নিজেকে ‘সাদা’ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই চোখে পড়ত। একজন নারীকে ‘ফরসা’ দেখানোর জন্য সামাজিক যে সুড়সুড়ি, তা বেশির ভাগই অনুভব করত এবং সেই ‘ফরসা’ হওয়াই অনেকের জীবনে আরাধনা হয়ে উঠল।

সরাসরি গায়ের রং নিয়ে কথা না বললেও কিংবা এটা তোমার রঙের জামা নয়, ফরসা মানুষ পরলে ভালো লাগবে কিংবা এটা পরলে তোমাকে আরও কালো দেখাবে, নারীর মনে এই কঠিন রাজনীতি ঢুকিয়ে দিয়ে শুরু হলো বাণিজ্যের বসতি। বাজারে আসতে থাকল নানা ধরনের রং ফরসাকারী ক্রিম এবং এটির প্রসারও বাড়তে থাকল। কারণ, নারীকে যেকোনোভাবেই ‘ফরসা’ হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেনে শারীরিক ক্ষতির কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ত্বক ফরসাকারী ক্রিম।

ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় রং ফরসাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন বন্ধে (আপত্তিজনক বিজ্ঞাপন আইন, ১৯৫৪) একটি খসড়া বিলের প্রস্তাব করেছে। এসব ক্রিমের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অথচ আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতের বর্তমান আইনে এসব বিজ্ঞাপনের জন্য জরিমানাসহ ৬ মাসের জেল অথবা যেকোনো একটি শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে খসড়া বিল অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুটিরই বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে জরিমানার পরিমাণ হবে ৫০ লাখ টাকা এবং পাঁচ বছরের জেল।

শুধু ক্রিমের বিজ্ঞাপন দিয়েই বর্ণবাদ থেমে থাকে না; গায়ের রং অপেক্ষাকৃত ফরসা দেখানো যাবে—এমন ফিল্টারযুক্ত ক্যামেরা অ্যাপ ছাড়া হয়েছে। কিন্তু অ্যাপটি ‘বর্ণবাদী’ বলে সমালোচিত হওয়ার পর এর নির্মাতারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটির নাম হচ্ছে ‘ফেসঅ্যাপ’, যা দিয়ে কেউ তার ছবি তুলে তাতে নানা রকম পরিবর্তন করতে পারে। চোখে চশমা থাকলে বাদ দেওয়া যায়, মুখের গড়ন পরিবর্তন করা যায়, আরও এমন কিছু পরিবর্তন করা যায়, যাতে বয়েস কম বা বেশি দেখানো যায়, তাকে আরও আকর্ষণীয় দেখানো যায়। কিন্তু এতে যখন মুখের ত্বকের রং ‘আরও ফরসা’ বা ‘উজ্জ্বল’ করার অপশনটি যুক্ত হলো, তখনই শুরু হলো বিতর্ক।

তবে ত্বক ফরসা মানেই সুন্দর—এই ধারণা থেকে বের হতে না পারলে এ ধরনের ক্রিম, বিজ্ঞাপন, ফেসঅ্যাপ নিয়ে বিতর্ক খুব বেশি কাজ করবে না।

হ্যাঁ, আমি ফরসা না, আমাকে যদি আপনারা গ্রহণ করতে না পারেন, সেটি আপনাদের সমস্যা। নিজেকে সমস্যা থেকে মুক্ত করুন।

ঔপনিবেশিকতাকে সমন্বিতভাবে ঘায়েল করেছি আমরা, কিন্তু মননে প্রতিনিয়তই পুষে চলেছি তাদেরই দেখানো সৌন্দর্যের মাপকাঠি।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]