ভোটার অনুপস্থিতি: নীরবতার সশব্দ ভাষা

ইংরেজিতে একটি কথা আছে। তা হলো, ‘সাম টাইমস সাইলেন্স স্পিকস লাউডার দেন ওয়ার্ডস’। এর সাদামাটা অনুবাদ, কখনো নীরবতা সরবের চেয়ে সশব্দ। এ কথা অনেকটা মিলে যায় আমাদের ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের গেল নির্বাচন আর চট্টগ্রামের একটি সংসদ উপনির্বাচনে ভোটারের শোচনীয় অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে।

চট্টগ্রামের সে উপনির্বাচনটিতে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২৩ শতাংশ। আর ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ২৫-৩০ শতাংশ। এটা নির্বাচন কমিশনের হিসাব। গণমাধ্যম ও জনশ্রুতি মতে, আরও কম। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। একই সুরে কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, যিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। তা ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারও এতে কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছেন।

অনেকেরই মতে, ভোটারের ব্যাপক অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। চট্টগ্রামের উপনির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সংসদের মেয়াদ রয়েছে এখনো প্রায় চার বছর। দুজন প্রার্থীই তৃণমূলের রাজনীতিক এবং জোরালো প্রচারণা চালিয়েছেন। ঠিক তেমনি ঢাকার দুই সিটির মুখ্য চারজন মেয়র প্রার্থীও সুপরিচিত এবং যথেষ্ট যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সরকারি দলের প্রচারের বিপরীতে বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচার কিছুটা নিষ্প্রভ হলেও উপেক্ষণীয় ছিল না। এখানে বিজয়ী দুজন প্রার্থী মোট ভোটারের যেটুকু সমর্থন পেয়েছেন, তা আমাদের নির্বাচন সংস্কৃতিকে বড় ধরনের একটি ঝাঁকুনি দিল।

সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। সবাই স্বীকার করবেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক হয়। এখানে কাউন্সিলর প্রার্থীরা তৃণমূলে কাজ করেন। তাঁদের কাছে অনেকের প্রায়ই বিভিন্ন কাজে যেতে হয়। তা ছাড়া নিকট আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীর বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বরাবর এসব নির্বাচনে ভোটারের ব্যাপক উৎসাহ থাকে। নিকট অতীতেও এ-জাতীয় নির্বাচনে বৃদ্ধ, চলনশক্তিহীন ভোটারকে সবল নিকট আত্মীয়রা বহন করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি। অথচ এখন ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হতে চাইছেন না।

মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে। তাঁরা উভয়েই ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত। অথচ দলটির চরম দুঃসময়েও ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ৩০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। তাহলে তাদের সমর্থক ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে গেলেন না কেন? এটা কি আমাদের নির্বাচন সংস্কৃতির প্রতি অনীহা কিংবা অন্য কিছু? অথচ ২০১৮-এর শেষ জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচন কমিশনের হিসাবে ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। তাহলে তারা হঠাৎ চুপসে যাচ্ছেন কেন? এগুলো ভেবে দেখার বিষয়। এখানে তলিয়ে দেখা প্রয়োজন কার দায়দায়িত্ব এটা।

২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদ দেশের সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। অবশ্য এখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায় তাদের জন্য সহায়ক হয়েছিল। সংবিধানের সে ব্যবস্থার আলোকে ২০১৪-এর নির্বাচনটি বিএনপি ও তার সহযোগীরা বর্জন করে একটি আত্মঘাতী সহিংস আন্দোলনের সূচনা করে। আত্মঘাতী বলা চলে এ কারণে যে এটা সরকারকে দমননীতি ব্যাপকভাবে চালাতে সুযোগ করে দেয়। আর দীর্ঘস্থায়ী হরতাল-অবরোধজাতীয় কর্মসূচিতে জনগণকে ধরে রাখা যায়নি। ফলে সেই একতরফা নির্বাচনে আবারও ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। এর যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও জনগণের নীরবতায় কার্যত বৈধতা পেয়ে যায় সংসদ ও সরকার।

অন্যদিকে বিরোধী দলের সংগঠন হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। এর ছাপ দেখা যায় গত সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনে তারা অংশ নিলেও সাংগঠনিক ভিত্তি অতি দুর্বল থাকায় এবং সরকারের খোলাখুলি হস্তক্ষেপে অবস্থা আরও নাজুক হয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত নির্বিকার ছিল। এ নির্বাচনের বিরুদ্ধেও বিরোধী দল কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো অনেকটাই সরকারের প্রভাবমুক্ত ছিল। কিন্তু পরের মেয়াদে সেখানেও ছাড় দেওয়া হয়নি। বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা হেনস্তা হতে থাকেন। ভোটকেন্দ্রে সরকারি দলের প্রতিষ্ঠিত হয় একক নিয়ন্ত্রণ। তাই যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। সুতরাং অনেকেই ধরে নিচ্ছেন সরকারি দলের প্রার্থীই জয়লাভ করবেন সর্বত্র। এবারের ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ যেটুকু এসেছে, তা খুব বেশি নয়। প্রকৃতপক্ষে তাদের এজেন্ট বা কর্মীদের ভোটকেন্দ্র কিংবা তার আশপাশে দৃশ্যমান উপস্থিতি ছিল না।

এসব দেখেশুনে বারবার স্মরণকালীন নির্বাচনগুলোর ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, ভোটার যেখানে নিজেকে প্রয়োজনীয় মনে করবেন, তিনি যাবেন। তবে এর জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এর দায় অবশ্য একতরফাভাবে কমিশনের ওপর দেওয়া চলে না। এ দেশে সরকার সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষপাতহীন আচরণ সে ধরনের পরিবেশ গড়তে সহায়ক হয়। অথচ ঘটেছে এর বিপরীতটা। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সোচ্চার হয়েছে, তা-ও বলা যাবে না। তদুপরি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতি সরকারি দল সমর্থকদের একতরফা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হয়েছে।

চলমান এ সংস্কৃতিতে ভোটারদের একটি বড় অংশ ভোট দিতে যাননি। তা-ও কিছু গেছেন। দিয়েছেন ভোটও। বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীরাও বেশ কিছু ভোট পেয়েছেন। আর বলতে গেলে একেবারেই ভোটার যায়নি এমন নির্বাচনও আমরা এ দেশে দেখেছি। ১৯৭৭ ও ১৯৮৫-এর গণভোট এবং ১৯৮৮-এর নির্বাচন তাই ছিল। ভোটাররা ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা না গেলেও যাঁরা জয়ী হওয়ার তাঁরাই হবেন। এভাবে আলো-আঁধারের খেলা চলছে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। এখন ভোটের দিনে ভোটাররা নিজেদের এক দিনের সুলতান ভাবতে পারছেন না। এর দায়দায়িত্ব অনেকের। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাই হন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। পক্ষান্তরে ব্যবস্থাটি সক্রিয় ও জোরদার হলে রাষ্ট্রের কল্যাণ করার সুযোগ তাঁরা অনেক বেশি পান। জনগণ থাকে আস্থায়। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের উপলব্ধি তাই যথাযথ।

অন্যদিকে বিরোধী দলের ভাবা দরকার, তাদের সংগঠন সরকার তৈরি করে দেবে না। ঊর্ধ্বতন নেতারা কারাবন্দী কিংবা দেশান্তরে থাকলেও অন্যেরা সক্রিয় হলে এমনটি হয় না। কখনোই বিরোধী দলের যাত্রাপথ থাকে না কুসুমাস্তীর্ণ। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় যে বরেণ্য নেতারা এ দেশে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার উদ্দেশ্য বিরোধী দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাঁদের চলার পথও সুগম ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁরা সংগঠনকে দাঁড় করেছিলেন। জনগণ কিন্তু একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব উপলব্ধি করছে।

এবার ঢাকার সিটি নির্বাচন কিংবা চট্টগ্রামের সংসদীয় উপনির্বাচনে ভোটারদের শোচনীয় অনুপস্থিতির কারণগুলো খুব বেশি বলার প্রয়োজন নেই। তবে এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে রাজনীতিকদেরই। ভোটাররা ভোট দিতেই চান। এটা আমাদের দেশে এমনকি অনেকটা উৎসবের মতো। রাজনীতি যেহেতু জনগণের খেলা, সেখানে তাঁদের অংশগ্রহণের ঘাটতি এটাকে দুর্বল করবেই। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি খামখেয়ালি করে নয়। ছুটির দিনে বিশ্রামের প্রত্যাশাও নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁরা ভোট দিতে অভ্যস্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর বিরাট একটি অংশ সংগত ধারণা করছে, এ উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। তাই তাঁরা নীরব। আর এ নীরবতা কিন্তু সশব্দ। বক্তৃতা, বিবৃতি, মিছিলের চেয়েও জোরালো। এ নীরবতার ভাষা বুঝতে হবে রাজনীতিকদের।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]