আমার আর সাংবাদিক হওয়া হলো না

ছেলেবেলায় আমি সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হই। বাবা নিয়মিত বাসায় স্টেটসম্যান ও আজাদ পত্রিকা রাখতেন। পরে অবজারভার ও ইত্তেফাক যুক্ত হয়। ১৯৫০–এর দশকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্সের ছাত্র, তখনই প্রায় ঠিক করে ফেলি আমি সাংবাদিকতার পেশাই বেছে নেব। অবজারভার পত্রিকায় আমার দু-একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল। স্বপ্ন ছিল যে অবজারভার-এর আবদুস সালাম সাহেব, ইত্তেফাক-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরী, নুরুদ্দীন ও শহীদুল্লা কায়সারের মতো ডাকসাইটে তুখোড় সাংবাদিক হব।

১৯৫৮ সালে এমএ পাস করে সালাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন, ‘তুমি সাংবাদিকতার কিছুই জানো না। মাসিক ৮০ টাকার ভাতায় শিক্ষানবিশ সাংবাদিক পদে চাকরি নিতে পারো।’ মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক অনুরূপ মন্তব্য করে ১০০ টাকা ভাতা দিতে চাইলেন। আমার তখন ভালো বেতনের একটা চাকরি খুব প্রয়োজন। বাবা সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ভাইবোনদের কারোরই লেখাপড়া শেষ হয়নি। বাবার সংসারে দারুণ অভাব-অনটন, টাকাপয়সার টানাটানি। ভেবেছিলাম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেব, কিন্তু দেওয়া হলো না। ২৭৫ টাকা বেতনে আনন্দ মোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপকের চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহ চলে গেলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে নিয়মিত ঢাকা যাই।

সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে গুলিস্তানের রেক্স রেস্টুরেন্টে এক টাকা চার আনায় পরোটা-কাবাব খেয়ে আড্ডা দিই, নাজ সিনেমায় ইংরেজি ছবি দেখতে যাই। বিকেলে নিউমার্কেটে গিয়ে একমাত্র ইংরেজি বইয়ের দোকান মহিউদ্দীন অ্যান্ড সন্সে পেঙ্গুইন অথবা পেলিকান পাবলিশার্সের পেপার ব্যাক সিরিজের দুই টাকা মূল্যের একটি বই কিনে নিউমার্কেটে চক্কর দিতে থাকি, যদি মনের মানসীর দেখা পাই। তখন কনে দেখার প্রধান স্থান ছিল নিউমার্কেট।

এমনি করে ময়মনসিংহে চার বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমি বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী শেলী আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি থেকে ইডেনে বিএ পড়ছে। বড় ভাই নিউইয়র্কে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট দুই ভাই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত-আমেরিকা চলে গেল। একদিন প্রিন্সিপাল সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসেন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘হান্নান সাহেব, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি ক্লাসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন, সাবধান হয়ে যান।’ আমি বলি, ‘আমি সাহিত্য পড়াই। সাহিত্য তো সমাজ, রাজনীতি, মানুষের জীবনের কথা বলে।’ বুঝতে পারি, আইয়ুব খানের টিকটিকি শিক্ষকদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। এখন নোঙর তোলার সময় হয়েছে।

আমি ঢাকায় গিয়ে মরিয়া হয়ে চাকরি খুঁজি, কিন্তু তখন ঢাকায় চাকরির আকাল। সব চাকরি, সুযোগ-সুবিধা করাচি এবং ইসলামাবাদে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) নামের সরকারি সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন আমার এক বন্ধু। তিনি হঠাৎ একদিন খবর পাঠালেন, সেখানে সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হবে। পরদিন এপিপির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এ কে কোরেশি (কায়রো পিআইএ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান) ইন্টারভিউ নেবেন। আমি যেন সকাল ১০টা মধ্যে পুরানা পল্টনে এপিপি অফিসে উপস্থিত থাকি। আমরা প্রায় ৫০ জন লিখিত পরীক্ষা দিই। বিকেলে আমাদের ১০ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। ইন্টারভিউ নিয়ে কোরেশি করাচি চলে গেলেন। এক মাস পর আমি কোরেশির কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। আমাকে ২০০ টাকা ভাতায় শিক্ষানবিশ সাব-এডিটর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি ইতস্তত করি। ছোট ভাই হাসনাত আবদুল হাই সদ্য বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিয়েছে। তার কী পরামর্শ জানতে চাইলে ও বলল, ‘তোমার রিয়েল ওয়েজ ২০০ টাকার বেশি। চাকরিটি নিলে তোমার ঢাকা-ময়মনসিংহ দুই ঠিকানায় খরচ করতে হবে না।’ আমি বুঝতে পারি, আমার অর্থনীতি পড়া উচিত ছিল। আমি চাকরিটি নিতে সম্মতি জানালাম।

এপিপিতে যোগ দিয়ে আমার আশা ভঙ্গ হলো। সংবাদ সংস্থাটিতে তখন বিহারিদের আধিক্য ও কর্তৃত্ব। আমরা গুটিকয়েক বাঙালি। মাহবুব আলম, আমানুল্লাহ, জাওয়াদুল করিম, সাইফুল বারী ও মোজাম্মেল হক। আধা-বাঙালি আজিম সাহেব রুক্ষ ও বদমেজাজি। আমার চাকরির প্রথম দিন তিনি আমায় ডেকে বললেন, ‘তোমাকে এক বছর ডেস্কে কাজ করতে হবে। ডেস্কের গ্রাইন্ডিং মেশিনে তুমি উতরে গেলে তোমাকে রিপোর্টিংয়ে দেওয়া হবে।’ আমি অচিরেই গ্রাইন্ডিং মেশিনের তাৎপর্য বুঝতে পারি। দিনের পর দিন আমাকে নাইট শিফটে কাজ করতে হতো। রাত ৯টার পর থেকে আমাকে একাই দুর্গ সামাল দিতে হতো। তখনই যত সব চ্যালেঞ্জ। আদমজী পাটকলে শ্রমিক অসন্তোষ, পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত, সরকারবিরোধী আন্দোলন, রাস্তায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-মিছিল। তখন আইয়ুব খানের জমানা। কোন প্রতিবেদন যাবে, কোনটি যাবে না, আমাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। একটু ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আজিম সাহেবের অকথ্য ভাষায় তিরস্কার, ‘তুমহারা দিমাগ কিধার থা? তুম ঘাস খাতা হায়?’ আমি বলি, প্রতিবেদনটি তো প্রবীণ চিফ রিপোর্টার দিয়েছেন, কিন্তু তিনি শুনতে নারাজ। আমি দুঃখভারাক্রান্ত মনে রাত দুইটার পর বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ি। আমার স্ত্রী বলে, ‘কি গো, খাবে না, শরীর খারাপ? ইশ্ তোমার মুখের দিকে তাকানো যায় না। তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।’ আমার চাকরি ছাড়তে হলো না। চাকরিই আমাকে ছেড়ে দিল। সে এক কাহিনি।

তখন দীর্ঘদিন ভারতীয় সিনেমা পাকিস্তানে দেখানো নিষিদ্ধ থাকার পর ’৬৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চারটি কলকাতার বাংলা ছবি পূর্ব পাকিস্তানে দেখানো ছাড়পত্র পায়। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর এবং ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ঢাকা শহরে অভূতপূর্ব উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে। দুটি ছবিতেই নায়িকার ভূমিকায় মাধবীর অনবদ্য অভিনয়। বলাকা হলে মহানগর দেখার জন্য দুই টাকার টিকিট পাঁচ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।

একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, বিছানায় স্ত্রী শেলী নেই। অনেকক্ষণ তাকে খুঁজে পাই না। মনে হলো, অবশেষে শেলী কি এই অপদার্থকে ফেলে চলেই গেল? কিন্তু তা কী করে হয়? ওর মতো ভালো মনের মানুষ হয় না। ঘুমন্ত কাজের মেয়েকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করি। ও বলে, ‘ক্যান, তাইন তো শিরি, পারু আপার লগে বলাকা সিনেমা হলে টিকিট কিনতে গেছুন।’

আমি বলি, বলে কী, এই অন্ধকারে? আমি লুঙ্গি পরেই বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে দেখি, ওরা টিকিটের লাইনে ইট বিছিয়ে বসে আছে। টিকিট বিক্রি শুরু হবে সকাল ১০টায়। আমি কিছু না বলেই বাসায় ফিরে যাই। সকালে অফিসে গিয়ে কাউকে কিছু না বলে ‘Fantastic furore over Indian film Mohanagar’ শিরোনামে ‘ঢাকা আবালবৃদ্ধবনিতার পথের ঠিকানা বলাকা সিনেমা’ একটি প্রতিবেদন লিখি। পরদিন সকালে প্রতিবেদনটি সব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় লিড স্টোরি করে ছাপা হয়। আমি আনন্দে আত্মহারা। এখন আমার ইনক্রিমেন্ট ও রিপোর্টিংয়ে যাওয়া কে ঠেকায়?

বেলা ১১টার সময় আজিম সাহেব আমাকে ডেকে পাঠান। আমি আয়নায় চুল আঁচড়িয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতেই তিনি অবজারভার কাগজটা আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘ইয়ে তুমনে লিখা হায়?’ আমি মহা উৎসাহে বলি, ‘আমিই লিখেছি’। তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, ‘শাটআপ। হামকো কারাচি আওর ইসলামাবাদছে দো টেলিফোন মিলা। ইউ আর ফায়ার্ড।’

আমি বলি, ‘মেরা কিয়া কসুর স্যার?’ আজিম সাহেব উচ্চ স্বরে বলেন, ‘আভিই দপ্তরছে নিকাল যাও।’ তাঁর ঘর থেকে বের হলে সহকর্মীরা আমাকে ঘিরে জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে? আমার কথা শুনে তাঁরা বলেন, ‘হান্নান সাহেব, আপনি সরল-সোজা অধ্যাপকই রয়ে গেলেন। কেন বুঝতে চান না, এপিপি সরকারের একটি সংবাদ সংস্থা ও প্রচারমাধ্যম। তাতে ভারতীয় ছবির গুণগান কেন সরকার সহ্য করবে?’

চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে আমি দিশেহারা। আমার স্ত্রী বলে, আমাদের কী হবে গো? আমি বলি, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়।’ ধৈর্য ধরো, এত বড় পৃথিবীতে আমাদের একটু ঠাঁই হবেই। আজ বলতে দ্বিধা নেই, এপিপিতে এক বছর আজিম সাহেবের তিরস্কার ও নিগ্রহ সহ্য করে সাংবাদিকতা যতটুকু শিখেছিলাম, তা পরবর্তী সময়ে আমার সরকারি চাকরিস্থলে উপকারে এসেছিল। ওপরওয়ালাদের বলতে শুনেছি, আমার পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ, স্বচ্ছ ও সৎ।

আমি পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন লেখার অপরাধে সাংবাদিক হতে পারিনি, স্বাধীন বাংলাদেশে সে অবস্থার কতটুকু মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের সংবাদমাধ্যম মতপ্রকাশে কতটুকু স্বাধীন, সে বিবেচনা এখনো প্রাসঙ্গিক।

আবদুল হান্নান: সাবেক কূটনীতিক