ক্রিকেট: কই গেল আসল হিসাব?

অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

আমাদের জাতীয় সংসদে টাকার আলোচনা খুব ভালো হয়। আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ জয়ের প্রশংসার মধ্যেও টাকা ও প্লটের কথা এসেছে। বাংলাদেশ দলের সব খেলোয়াড়ের শিক্ষার ভার সরকারকে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন গণফোরামের সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। একই সঙ্গে তাঁদের নামে প্লট বরাদ্দের দাবিও জানান তিনি। খবরটা পড়ে পুরোনো একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘কাঠুরে গাছ দেখলেই ভাবে কাঠ আর কবি দেখে প্রাণ।’

যা-হোক, সাংসদেরা উদার হচ্ছেন। আগে জমি, প্লট, শুল্কমুক্ত গাড়ি, ঋণ, বাড়তি ভাতা ইত্যাদি তাঁরা কেবল নিজেদের জন্যই চাইতেন; এখন গুণী খেলোয়াড়দের জন্যও চাইছেন। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে এক ধরনের ওষুধ বিক্রি হয় যা নাকি সর্বরোগহর। কানপাকা থেকে ক্যানসার—সব নাকি ওই ওষুধে সারে। টাকারও ওই গুণ। টাকাই মাটি মাটিই টাকা। এটাই চলতি যুগের দেশাচার—আধুনিক বাংলাদেশিয় রীতি। এখন নাকি বিয়েশাদি-জন্মদিন ইত্যাদিতেও নাকি উপহার হিসেবে খামভরা টাকা দেওয়া হয়। হয়তো তা ভালো কিন্তু কার্যকর কি?

২০১৫ সালে বিশ্বকাপে ভালো করার পর ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ‘হোয়াইটওয়াশ’ করা এবং একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে হারানোয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কয়েক কোটি টাকা করে অর্থ পুরস্কারের পাশাপাশি দুটি করে ফ্ল্যাট ও গাড়ি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। দেশের জন্য সফলতা এনে দেওয়া খেলোয়াড়দের পুরস্কৃত করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে খেলাধুলার প্রেরণা শুধু জমির লোভে আসে না।

অনূর্ধ্ব-১৯ মানে সবারই বয়স আঠারোর ঘরে বা তার নিচে। এই বয়সে তাঁদের মধ্যে যাতে টাকার মোহ তৈরি না হয় সেই দিকটি বিবেচনায় থাকতে হবে। গত বছরের ডিসেম্বরের কথা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার খেলোয়াড় কেভিন-প্রিন্স জানিয়েছিলেন, তিনি আর খেলে মজা পান না। এর জন্য দায়ী করেন টাকার ‘অভিশাপ’কে। এই তুখোড় খেলোয়াড় টাকায় এতই মজেছিলেন, এক দিনে তিন তিনটি দামি গাড়ি কেনার রেকর্ডও আছে তাঁর। কবিই হোন বা খেলোয়াড়ই হোন, তাঁকে চালিত করে মনের ভেতরের অতৃপ্তি। আসলে তো ভালোবাসা ছাড়া কিছু হয় না। প্রেম ছাড়া কোনো কঠিন সাধনা কে করেছে কবে? যিনি খেলার প্রেমে পড়েছেন, তিনি নিজের সেরাটা দিতে চাইবেন। যিনি টাকার প্রেমে পড়েছেন, তিনি অর্থকরী ম্যাচের দিকে বেশি মনোযোগী হবেন; ক্রিকেটীয় জুয়ার ঘুঁটি হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারেন। সাময়িক টাকার মোহ হলো সেই মরিচা, যা খেলোয়াড়ের ধার নষ্ট করে দেয়। সাফল্য ধারাবাহিক থাকলে টাকা এমনিই আসবে।

তার মানে কি তাঁরা অভাবে থাকবেন? না, উপযুক্তের চাইতে বেশি সম্মানীই তাঁদের দিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধনসম্পত্তিই যেন বড় হয়ে না ওঠে সেই হিসাব-নিকাশটিও থাকতে হবে। আমরা শিরোপাজয়ীদের অঢেল অর্থকড়ি দেব, কিন্তু তৃণমূল থেকে ভালো ক্রিকেটার তুলে আনা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অবকাঠামোর পেছনে যথেষ্ট ব্যয় করব না, তা হয় না। জার্মানি ফুটবলে দুর্বার শক্তি হয়ে উঠেছিল এ জন্যই যে, তারা সারা দেশ থেকে, স্কুল পর্যায় থেকেই ফুটবলার তৈরিতে বিনিয়োগ করেছিল।

আর আমাদের দেশের অবস্থা কী? আরেকজন লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করি: ‘খেলোয়াড় তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে দেশের ক্রিকেট একাডেমিগুলো। এই একাডেমিগুলোর প্রতিযোগিতামূলক খেলার পথও বন্ধ করে দিয়েছে বিসিবি। আগে একাডেমিগুলো পাঁচ হাজার টাকা ফি দিয়ে তৃতীয় বিভাগের বাছাইয়ে অংশ নিত। কিন্তু বিসিবি ফি পাঁচ লাখ নির্ধারণ করে সেই পথও বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক একাডেমির পক্ষেই পাঁচ লাখ টাকা ফি দিয়ে খেলায় অংশ নেওয়া সম্ভব না। আবার পাঁচ লাখ ফি দিলেও খেলার সুযোগ পাওয়া যায় না। যেমন পূর্বাচল ক্রিকেট একাডেমি পাঁচ লাখ টাকা ফি দেওয়ার পর বাছাই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার ফরম পূরণ করতে পারেনি। তাদের সেই ফরমই দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হয়নি, সেটা বিসিবিই ভালো জানে।’

বিসিবির নির্বাচন হয় ক্লাবগুলোর ভোটে। ক্লাব হাতে থাকলে বিসিবির পদ পাওয়ার সুবিধা। ‘বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে একাডেমিগুলোর ভোট থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা পছন্দের একাডেমিগুলোকে খেলার সুযোগ দিচ্ছেন, অপছন্দেরগুলো বাদ পড়ছে। একজন সাবেক অধিনায়ক একই সঙ্গে বিসিবির একাধিক পদে যুক্ত। তিনি ক্লাবের ম্যানেজার আবার জাতীয় দলেরও ম্যানেজার। সম্ভবত, তিনিই সবচেয়ে বেশি পদ দখল করে আছেন বা ছিলেন।’

মাননীয় সাংসদের কি এসব অনিয়ম চোখে পড়ে না? স্কুলগুলোতে ভালো খেলোয়াড় তৈরির কী ব্যবস্থা আছে, মফস্বল ও জেলা শহরের খেলোয়াড়েরা কী পরিস্থিতিতে থাকেন, তাঁদের কোচেরা কী মূল্যায়ন পান। খেলা নিয়ে ভাববেনই যদি, তাহলে এসব দিকে কথা বলুন মাননীয় সাংসদ।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিখ্যাত ক্লাবগুলোর অনেকটিই জুয়ার আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। এসব ক্লাবের পরিচালনা বোর্ডে ক্যাসিনোবাজ মাফিয়াদের কর্তৃত্ব ছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা বিসিবির পরিচালনা বোর্ডেও ক্যাসিনো-কাণ্ডে কুখ্যাতদের কেউ কেউ ছিলেন এবং আছেন। আমাদের ক্রিকেটাররা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারেন, ক্রিকেটের পরাশক্তিদের হারাতে পারেন, কিন্তু বিসিবির কর্তাদের কাছে তাঁদের অসহায়ত্বের কথা কে না জানে? ঘরোয়া ক্রিকেট লীগের ব্যবস্থাপনা ও আম্পায়ারিং সুষ্ঠুভাবে না চললে কেমন করে যোগ্যরা উঠে আসবেন?

টাকা বিতরণ করে এসব হয় না। গোড়া শুকিয়ে আগায় পানি ঢালার প্রবাদটা যেন আমরা মনে রাখি।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk. wasif@prothomalo. com