গণ-অভ্যুত্থানের আশা ও বিএনপির সক্ষমতা

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পেরোল। বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাঁর মুক্তির আশা নেই, যদি না কোনো মিরাকল ঘটে। প্যারোল ও জামিন নিয়ে আলোচনা থিতিয়ে এসেছে। পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছিল যে জামিন পেলে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাবেন। আদালত থেকে বলা হয়েছিল, তাঁর চিকিৎসকেরা যদি মনে করেন যে তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়া প্রয়োজন, তাহলে এটা তাঁদের জানাতে হবে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। চিকিৎসকেরা তো আর দলীয় ক্যাডার নন। তাঁরা নিশ্চয়ই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সত্যিকার ছবিটি তুলে ধরবেন। এ নিয়ে আদালতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। তাঁকে দরকারি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি এত অসুস্থ যে কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না, ঠিকমতো খেতে পারেন না।

বিএনপি খালেদা জিয়ার কারাবাসের দ্বিতীয় বার্ষিকী পালন করেছে একটি সমাবেশের মধ্য দিয়ে। সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতিতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে নয়াপল্টনে দলের অফিসের সামনে রাস্তায় জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। অবধারিতভাবেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওই রাস্তায়। সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়েছে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, মিথ্যা মামলা সাজিয়ে’। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দানবকে (সরকারকে) পরাজিত করতে হবে এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে’ (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। বিএনপির অন্য নেতারাও আন্দোলন করে তাঁদের নেত্রীকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি আন্দোলনের মাধ্যমে দৃশ্যপট পাল্টাতে পারবে?

বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলে তাদের কোনো কোনো শরিক প্রায়ই মশকরা করেন। বিএনপি কেন আন্দোলন করতে পারছে না, এ নিয়ে তারাও চিন্তিত। আবার আন্দোলনের কথা শুনলে তাদের কেউ কেউ বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর ষড়যন্ত্র করছে এবং তা বরদাশত করা হবে না। বিএনপির আন্দোলনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অতিশয় নির্ভার থাকার একটা গন্ধ পাওয়া যায়, আবার কখনো-সখনো একটু নার্ভাস হওয়ার লক্ষণও বোঝা যায়।

দুটি ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ এগিয়ে আছে। তাদের নেতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন। তিনিই মুশকিল আসান করবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রশক্তি আছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে। অর্থাৎ লড়াইটা সমানে সমানে হচ্ছে না। বিএনপির নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন যে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। তাঁরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছেন।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন ভালো ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা জানে। এ জন্যই তারা সবাই মিলে একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল। তখন বিএনপি এর বিরোধিতা করেছিল। পরে অবশ্য বিএনপি এটা মেনে নিয়েই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বিল এনেছিল। কিন্তু সেটি আপনা-আপনি হয়নি। এ জন্য আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তুমুল গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপিকে দাবি মানতে বাধ্য করেছিল।

বিএনপি কি আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করার শক্তি রাখে? আমরা দেখেছি, ২০০৬ সালের পর থেকেই বিএনপি ব্যাকফুটে। তাদের আছেন অগুনতি নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু তাঁরা অর্থবহ একটি আন্দোলন কেন তৈরি করতে পারছেন না? এ নিয়ে তাঁদের দলের মধ্যেও আছে নানান কথা, গুঞ্জন, ফিসফাস।

বিএনপি কি রাষ্ট্রক্ষমতার রসায়নটি বুঝতে পারে? রাষ্ট্রশক্তির মাজেজা কি তারা জানে না? রাষ্ট্রশক্তি যত দিন তাদের পক্ষে ছিল, বিএনপি তত দিন ক্ষমতায় ছিল। এখন রাষ্ট্রশক্তি তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে তারা খাদের কিনারায় পড়ে গেছে। এটা হলো মূল বাস্তবতা। ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয় এবং ক্ষমতাচ্যুত হলে যে বৈরী পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, এটা ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি বোঝেনি। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। কথায় কথায় ১৪৪ ধারা জারি করে বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচাল করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি তাদেরকে বলতে চাই যে আপনারা আজ ক্ষমতায় আছেন, আগামীকাল ক্ষমতায় না-ও থাকতে পারেন। হয়তো বিরোধী দলে থাকবেন এবং তখন কিন্তু আপনাদের সভায় এই ১৪৪ ধারা জারি করা হতে পারে।’ ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো বুঝতে পারেন না, ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে তাঁরা কত অসহায়।

গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান—এই শব্দগুলো অতিব্যবহারে অকেজো হয়ে গেছে। এগুলো এখন নিতান্তই বাগাড়ম্বর। এ দেশে ঘোষণা দিয়ে কখনো গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। আমার দেখা গণ-অভ্যুত্থান হলো ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি। প্রথমটির পটভূমিতে ছিল কিশোর মতিউরসহ ছয়জনের গুলিতে নিহত হওয়া এবং পরেরটি ছিল সার্জেন্ট জহুরুল হকের নিহত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তখন সারা দেশে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ দফার আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনের একপর্যায়ে শাসক আইয়ুব খান গদিচ্যুত হন এক সামরিক অভ্যুত্থানে।

আমার দেখা শেষ গণ-অভ্যুত্থানটি ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর। সেদিন এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। ছাত্রসংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে ছিল। একপর্যায়ে পেশাজীবীরা আন্দোলনের সমর্থনে বেরিয়ে এলে সরকারের ভিত নড়ে ওঠে। তখনো নেপথ্যে চলছিল সামরিক বাহিনীর এক নীরব অভ্যুত্থান। তারা এরশাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দুই দিন পর পদত্যাগ করেছিলেন এরশাদ।

এসব ঘটনার কোনোটিই আগাম ঘোষণা দিয়ে হয়নি। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সমগ্র জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবী সংগঠন থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনকি কারফিউ অমান্য করেও দলে দলে মানুষ পথে বের হয়েছিল। সে রকম একটি আন্দোলন সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো জাতিকে পাশে পাওয়া। ওপিনিয়ন মেকার হিসেবে যাঁরা ভূমিকা রাখতে পারেন, সেই সব ব্যক্তি, সংগঠন, গোষ্ঠীকে সঙ্গে পাওয়া। বিএনপি কি এ রকম একটি আন্দোলনের জন্য তৈরি?

এ জন্য বিএনপিকে প্রথমেই বুঝতে হবে, মানুষ কেন বিএনপির পক্ষে দাঁড়াবে, কেন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য গুলির মুখে বুক পেতে দেবে। দেশে অনেক সমস্যা। প্রতিটি খাতে কমবেশি দুর্বৃত্তায়ন। মানুষ ফুঁসছে। এসবই সত্য। কিন্তু মানুষ কী বিকল্প দেখে? একজনের বদলে আরেকজন প্রধানমন্ত্রী? একদল ঠিকাদারের পরিবর্তে আরেক দল ঠিকাদার? ঘরের ভেতরে বসে অনেকেই সরকারকে তুলাধোনা করেন। উঠতে-বসতে ক্ষমতাসীন দলের মুণ্ডুপাত করেন। তাতে সরকারের কিচ্ছু যায়-আসে না। ক্ষমতাসীনেরা জানেন, তাঁদের জনসমর্থন যতই কমুক এ মুহূর্তে তাঁদের বিকল্প নেই। মানুষ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বিএনপির জন্য জান দেবে না। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হলেও নির্বাচনের দিন বুথ দখল হলে তার প্রতিবাদ করে না। সিটি নির্বাচনে দেখা গেল, ১০ জন সাংবাদিক পেশাগত কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন, হাসপাতালে গেলেন। অথচ বিএনপির একজন নেতা-কর্মীও মার খেয়ে হাসপাতালে গেছেন বলে শুনিনি। লাখো মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পথে বেরিয়ে এলে বা দিনের পর দিন পথ অবরোধ করে ঠায় বসে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে তবেই পালাবদলের স্বপ্ন দেখা যায়। তার প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার লক্ষণ আপাতত দেখছি না। এর ফলে বিএনপি নয়, ভুগছে সাধারণ মানুষ। একপক্ষীয় পলিটিকসে নাগরিকেরা কোনো জায়গা পান না। এ জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই দায়ী।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]