নারী নির্যাতন: আইনের দুর্বল প্রয়োগ থেকে সরতে হবে

নারী নির্যাতন। প্রতীকী ছবি
নারী নির্যাতন। প্রতীকী ছবি

পথেঘাটে, ট্রেন-বাসে তো বটেই, এমনকি বাসা, স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে শিশু ও নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। নারী ধর্ষণ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বটে, কিন্তু অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রভাবশালীদের দাপটে অনেকে মুখ বন্ধ করে থাকতে বাধ্য হন।

অথচ নারী নির্যাতন রোধে অনেক আইন আছে। প্রয়োগ দুর্বল। আর তা ছাড়া যেসব মামলা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে এমন দুর্বলভাবে সাজানো হয় যে অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে যান। সেই সব অপরাধী ফিরে এসে নির্যাতিত নারীর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনকে হুমকি দেন। এসব খবর পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন বেরোয়।

আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি। কিন্তু নারী যখন কলকারখানায় কাজ করতে যান বা অফিস-আদালতে কাজ করেন, সেখানে কী পরিবেশে তাঁরা কাজ করেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কি তার খবর রাখে? বিশেষভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীরা কীভাবে নিত্য যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং এর প্রতিকার কী, এসব বিষয়ে সেদিন প্রথম আলোর আয়োজনে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিস্তৃত আলোচনা হয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতির অবসানে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

একটা উদাহরণ দেখুন। গার্মেন্টস সেক্টরের নারী কর্মীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মনে করেন, তাঁদের কারখানায় কাজের পরিবেশ নারীদের জন্য অনিরাপদ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি রোধের প্রতি ফাউন্ডেশন গুরুত্ব আরোপ করে জরিপটি চালায়। জরিপে বলা হয়েছে, নারী কর্মীরা যদি কারখানায় শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও মানসিক ভয়ভীতির শিকার হন, তাহলে উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে।

যেসব কারখানা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হবে, তাদের নন-কমপ্লায়েন্ট (প্রচলিত আইন মেনে চলতে ব্যর্থ) বলে গণ্য করা হবে, এ রকম একটা বিধি থাকা দরকার। সেটা শুধু গার্মেন্টস সেক্টরে নয়, অন্যান্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের বিধিমালায় থাকতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য যেন দেশে বা বিদেশের বাজারে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলেই আমরা সভ্য দেশ বলে দাবি করতে পারব।

এখানে আরেকটি কথা। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ মাত্রায় গেছে, যেভাবে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আইনের কড়াকড়ি না থাকলে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে না। সুনির্দিষ্ট বিধান ছাড়া অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনে যৌন হয়রানির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির আইন ও বিধিমালা জারি করা হোক। না হলে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী শুধু নির্যাতিতই হবে না, ওরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যাবে। এটা দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে।

আচ্ছা, একটা ছোট্ট প্রশ্ন দেখুন। দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসসহ কলকারখানায় নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সব ধরনের নির্যাতন রোধে ফলপ্রসূ উদ্যোগ কি নেওয়া যায় না? কর্তৃপক্ষ হয়তো বলবে, সে উদ্যোগ তো আছেই। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই সব প্রতিষ্ঠানে ঢোকার গেট থেকে শুরু করে ক্যানটিন, অফিসকক্ষ প্রভৃতি স্থানে কি চোখে পড়ার মতো বড় বড় অক্ষরে সতর্কবাণী লিখে রাখা যায় না যে কোনো নারী কর্মী যদি যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তির শুধু চাকরিই যাবে না, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। এবং মালিক বা কর্তৃপক্ষই সেই নির্যাতিত নারীর পক্ষে আদালতে লড়বেন। অর্থাৎ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে নারী নির্যাতন যে ভয়াবহ মাত্রায় গেছে, সেটা রোধ করা কঠিন। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো যেন কেউ ধামাচাপা না দিতে পারে, সে জন্য এমন প্রকাশ্য অবস্থান নিতে হবে। জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

নারী যেকোনো স্থানে নির্যাতন বা হুমকির মুখে পড়লে ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে প্রতিকার পেতে পারেন। আরও কিছু উদ্যোগ সরকারের আছে। সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন জানান, ৩৩৩ ও ১০৯ নম্বরে আরও দুটি হেল্পলাইন রয়েছে। সম্প্রতি এই তিনটি হেল্পলাইনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়েছে। এখন এই তিনটি নম্বরের যেকোনোটিতে কল দিলে একসঙ্গে তিন জায়গাতেই যাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা হচ্ছে। ফলে দ্রুত ও সহজে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

আবুল হোসেন জানান, সরকারের এই বিভাগ থেকে হয়রানি মোকাবিলার একটি ডিজিটাল ব্যবস্থা হিসেবে তাঁরা জয় মোবাইল অ্যাপ চালু করেছেন। এই অ্যাপ ডাউনলোড করে মোবাইলে রাখলে আত্মরক্ষার একটি অব্যর্থ কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ, এই অ্যাপে চাপ দিলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলের ক্যামেরা অন হয়ে যায় এবং যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়িতদেরসহ চারপাশের ছবি ওঠে, পুলিশসহ সবখানে বিপন্ন নারীর খবর পৌঁছে যায়। জিপিআরএসের মাধ্যমে হয়রানির শিকার নারীর অবস্থানও তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়। এই অ্যাপ সম্পর্কে ভালো প্রচার দরকার।

মোটকথা, গতানুগতিক ধারায় চলবে না। নারী ও কন্যাশিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন রোধে সরকার ও কর্তৃপক্ষের এখনই দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নারীর প্রতি যৌন ও শারীরিক নির্যাতন, হয়রানির সর্বনাশা অপরাধ দমন করতে সরকারের যা কিছু করা দরকার, করতে হবে। জনসাধারণকেও সজাগ ও সচেতন হতে হবে। নারী নির্যাতনকারীদের কোণঠাসা করে ফেলাই হোক সবার লক্ষ্য।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]