'ছাইড়া আসা' তরুণের মন

‘আমি অনেক কিছু ছাইড়া আসা লোক’ বলে বইমেলায় সাড়া তুলেছে কবি মারজুক রাসেলের কবিতার বই। বইটার নাম ‘দেহবণ্টনবিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর’। নব্বই দশকের উঠতি মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে অবসকিউর ব্যান্ডের একটা গান খুব শোনা হতো, ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী/ জীবনখেলায় হারাইলাম সবই,/ বুকে জমাট বাঁধা অভিমান/ কী নিঠুর এই নিয়তির বিধান। এই ‘ছাইড়া আসা’র আবেগ তরুণের মনে টনটন করে বাজে। বয়সের আবেগের কারণে তো বটেই, অস্বচ্ছল পরিবারের কষ্ট সওয়া সব তরুণই তো একেকজন দুখু মিয়া। ছাইড়া আসতে গিয়া এই দুখু মিয়াদের মনের তার ছিঁড়ে যায়। ছেড়ে আসার সুর হয় তার জীবনের স্থায়ী আবহ সংগীত। জন্মের গ্রাম-মফস্বল ছেড়ে আসতে হয়, পরিবার ছাড়তে হয়, প্রথম প্রেম ছেড়ে আসতে হয়, ছেড়ে আসতে হয় কিশোরবেলার রোমাঞ্চভরা সব স্বপ্ন। অনেক কিছু ছেড়ে আসার সমাহার তার জীবন। তাই মারজুক রাসেল ‘আমি অনেক কিছু ছাইড়া আসা লোক’ বলামাত্রই অনেক তরুণের মনের সেই ছেঁড়া তন্ত্রীতে টংকার ওঠে। তাই তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে ফেসবুকের কবিতাপাড়ার অনেক তরুণ।

ছেঁড়া তার যিনি বাজাতে পারেন, তরুণেরা তাঁকেই ভালোবাসে। হোন তিনি নেতা বা অভিনেতা, কবি বা বীর, খেলোয়াড় বা গায়ক। তরুণের মনে তিনিই নায়ক। নায়কের ভীষণ ক্ষুধা আমাদের সময়ে। যাঁকে ভালোবাসা যাবে, যাঁর জয়-পরাজয়ের মধ্যে নিজের জয়-পরাজয় খুঁজে নেওয়া যাবে, তেমন কারও জন্য ক্ষুধার্ত এই সময়। সেই নায়ককে মহান হতে হবে না, ত্রুটিহীন হতে হবে না, সভ্য-সুজন হতে হবে না—মার-খাওয়া সুবোধ কিংবা হিরো আলম হলেও চলবে। হতে হবে আমাদেরই মতো তুচ্ছ। আমাদের মতো হলেও আমি যা পারি না, সে তা পারবে। মিডিয়ার এলিটপাড়ায় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে, ভোটকেন্দ্রে একাই দাঁড়িয়ে যাবে প্রতিবাদে। এলিট মহলে জায়গা পেতে আছাড়ি-পিছাড়িও করবে। আপস আর বিদ্রোহ তার দুই পায়ে, একই সঙ্গে বেয়াড়া আবার হীনম্মন্য সে। সেই নায়ক হবে ভাঙা হাঁটুর ক্যাপ্টেন মাশরাফি, কাটার মাস্টার মোস্তাফিজ, অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপজয়ী নিম্নবিত্তের আকবরদের মতো। কখনো তাকে দেখা যাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে কিংবা কিশোর বিদ্রোহের কিশোরদের মধ্যেও। এই নায়কেরা ব্যর্থ হলে বা পাল্টি দিলে আবার নতুন নায়কের খোঁজ পড়বে। কিছু দিন কাশেম বিন আবু বকরের মধ্যে মনের কথা খোঁজা হয়েছে, এখন খোঁজা হচ্ছে অন্য জায়গায়। নায়ক আমাদের লাগবেই লাগবে। কারণ, ভরসা লাগবে আপন মানুষ লাগবে।

বাস্তবে নায়কতা করে ক্ষমতাবান এমপি, গডফাদার, রাজবংশের সন্তান, মিলিয়নিয়ারেরা। তাদের দেখনদারি জীবনের সামনে পড়ে উঠতি মধ্যবিত্ত সন্তানের মন ছোটো হয়ে যায়। গত এক দশকে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশি তরুণেরা অনেক ভুগেছে। অনেক রকম মার খেয়ে খেয়ে তাদের জিদ না কমে বরং বেড়েছে। নিস্তেজ হয়ে কোথাও একটা তেজ, নায়কোচিত কাজ তারা চেয়েছে। কতজনকে নিয়ে তারা নেচেছে, আরও নাচবে। আবার নায়কের পতন হলে বা মেয়াদ ফুরালে অবলীলায় তাকে ছেড়েও যাবে। কিন্তু ক্ষুধাটা রয়ে যাবে।

বিপ্লবপূর্ব রুশ লেখক মিখাইল লেরমন্তভের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আমাদের সময়ের নায়ক’। বইটা অনেক ভাষার মতো বাংলায়ও তরজমা হয়েছে। লেরমন্তভের নায়ক অভিজাত, সামরিক অফিসার, প্রেমিক, সুদর্শন এবং ট্র্যাজিক। বাংলাদেশে আমাদের সময়ের নায়ক উল্টো চেহারার মানুষ। গ্রাম–মফস্বল থেকে আসা কবি আলফ্রেড খোকনের ভাষায় ‘নগরে নিবন্ধনহীন’।

বাংলা সিনেমার এই ‘খোঁজ দ্য সার্চ’–এ যাওয়ার আগে তো বলা দরকার ‘আমাদের’ বলতে কাদের কথা বোঝানো হচ্ছে? যারা কাউকে জনপ্রিয় করে, এই ‘আমরা’ তারা। নাটক-গান-সিনেমা-সাহিত্য ও আন্দোলন যারা জনপ্রিয় করে, তারা কারা?

উঠতি মধ্যবিত্তরাই বাংলাদেশের জনতার পাওয়ার হাউস । তারা ভোটে যার সঙ্গে থাকে, তারাই জেতে। আন্দোলনের মাঠে তারাই জয়ী করে কোনো দলকে। তারা বই কিনলে লেখক মহান হন। তারা নিজেরা হয়তো শক্তিধর নয়, কিন্তু তাদের মনে ঠাঁই না পেলে বাংলাদেশে কেউ কেউকেটা হতে পারে না। মহানগরীর মহানাগরদের জৌলুশের পাশে উৎসাহী মন ও তাজা অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়েছে এই শ্রেণির তরুণেরা। হ‌ুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এরা ছিল মৃদু মানুষ। কিন্তু এরা এখন পোড়খাওয়া। এদের আর মৃদু বলা যাবে না। প্রবল হতে চেয়ে এরা বারবার মাথা তুলছে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে। সাহিত্যেও এরা তাদের নায়ক-লেখক-কবি খুঁজবে।

টাকা ও শিক্ষার পুঁজি কম হওয়ায় এদের মনটা ছোট ও দুঃখী হয়ে থাকে। আবার জীবনের সহজ আনন্দ-উল্লাসের প্রতি এদের বেদম ঝোঁক। তাই তারা মোটিভেশনাল বই পড়ে শিখতে চায় সফলতার সূত্র, উঠতে চায় উচ্চ নম্বরের সিঁড়িতে। এদের জন্য হোমমেড ডেল কার্নেগিরা তাই হাজির আছেন। তেমনি প্রেম ও প্রেমহীনতা, যৌন অবদমন ও ব্যাটাগিরি কথার প্রতিও এদের দারুণ টান। এলিটদের জবাব দেওয়ার ভাষা এরা কবিদের কাছেও খুঁজতে চায়। এদের বড্ড অভিমান সবকিছুর প্রতি।

মারজুক রাসেলের ছেঁড়াখোঁড়া চলন-ফিরন, সরল দুঃখের কহন, যৌন পীড়ানিকে আজকের অনেক তরুণ ভালো পায়, নিজের করে পায়। এই কারণে তাঁর লেখা গান জেমস কিংবা মমতাজ গেয়ে আরও জনপ্রিয় হন। সাহিত্যসভাতেও যখন ক্ষমতা ও বিত্তের তাকিয়ায় হেলান দেওয়া লোকেদের দাপট, তখন ‘অনেক কিছু ছাইড়া আসা’ মারজুককে কাঁধে তুলে তারা জবাব দিতে চেয়েছে। তাই আরেকজন গুণী লেখক যখন ফেসবুকে নিরীহভাবে জানতে চান, ‘ইনি আবার কে?’ তখন ফুঁসে ওঠে অনেকে। উঠতি মধ্যবিত্তের এলিটবিদ্বেষ তখন লাগামছাড়া হয়।

মহাকাল এসবের কী রাখবে আর কী রাখবে না, তা মহাকালই জানে। তবে প্রতিভাবান একটি বা দুটি কবিতা লেখেন না, তিনি সাজিয়ে দেন নতুন সময়ের ভাষা। রবীন্দ্রনাথ যেমন করেছেন, নজরুল যেমন করেছেন, জীবনানন্দ যেমন করেছেন, আল মাহমুদ যেমন করেছেন। তাহলেও বাংলাদেশে সাহিত্য-সংগীত-সিনেমার মধ্যে ইতিমধ্যে নতুন নায়কের উঁকিঝুঁকি অস্বীকার করা যাবে না। জেমসের গানে সেই নায়ক যেন দুখু মিয়া নজরুলের হাহাকার করে। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সিনেমায় তাকে পাই বহুবাসনায় জর্জরিত অবস্থায়। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ সিনেমায় সে বহুরূপী হয়; ধূর্ততাই তখন তার কৌশল। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সে হাজির হয় আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে। আবার মারজুক রাসেলের কবিতায় সে পায় তার আহত অহংয়ের রুখা ভাষা।

শিল্পের জায়গায় দাঁড়িয়ে নয়, সমাজ বোঝার জায়গা থেকে দেখি, এ ধরনের অজস্র উঠতি নায়কের ঢলের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। তাদের সেই আবির্ভাবে সাহিত্য থেকে রাজনীতি—সবই বদলে যেতে পারে। ঢলের সবই ভালো তা না, সবই খারাপ তাও না। শাঁখের করাতের মতো এটা দুদিকেই কাটে। সে যা হোক, কিন্তু একটা ‘পপুলার’ শ্রেণির আবির্ভাব চলছে, তারই ইশারা এইসব ছোট ছোট ঝলকে। একে ভাল করে খেয়াল করা দরকার।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]