বই, বইমেলা ও প্রকাশনাজগৎ

বইমেলায় সমগ্র জাতির রুচি, মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়
বইমেলায় সমগ্র জাতির রুচি, মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়

বই একটি বস্তু এবং একটি পণ্য। সব বই নয়, কোনো কোনো বই অমূল্য বস্তু। যাকে অর্থমূল্য দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। সব দেশেই বিভিন্ন পণ্যের মেলা হয়। গুরুত্বের দিক থেকে বইমেলার সঙ্গে অন্য কোনো পণ্যের মেলা তুলনীয় নয়। বইমেলায় সমগ্র জাতির রুচি, মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। বইমেলায় একটি জাতির অতীত ও বর্তমানের পরিচয় শুধু নয়, পূর্বাভাস পাওয়া যায় ভবিষ্যৎটি কেমন হবে। এখন সারা বছরই ছোট-বড় বইমেলা হয়, তবে একুশের বইমেলা জাতির বৃহত্তম ঘটনা।

বইমেলার সঙ্গে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আপাত সম্পর্ক নেই, কিন্তু সম্পর্ক হয়ে গেছে। বায়ান্নর পরবর্তী কয়েক বছর পরম শোকাবহ পরিবেশে একুশের শহীদদের স্মরণ করা হতো। সেদিন আমরা কেউ জুতা পায়ে দিতাম না। নগরীতে বিরাজ করত এক স্তব্ধ নীরবতা। অনেকে বুকে সেঁটে রাখতেন আলপিন দিয়ে এক টুকরা কালো কাপড়। হাজার হাজার মানুষ ভোররাত থেকে নীরবে লাইন ধরে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদের কবরে হয় একটা ফুল দিত অথবা মিনিটখানেক নীরবে দাঁড়িয়ে থাকত।

ষাটের দশকে সামরিক শাসকের সময় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সারা দেশ থেকে প্রকাশিত হতো একুশের সংকলন। সেসব সংকলনের লেখায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটত। সেই সব সংকলন আমরা তরুণেরা শহীদ মিনারে বিক্রি করতাম। আজকের যে একুশের বইমেলা তার ভ্রূণ বলতে গেলে সেই একুশে সংকলন প্রকাশ ও শহীদ মিনারে বিক্রি। তারপর ১৯৬৮, ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের আমদানি করা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বইপত্র বিক্রি হতে থাকে শহীদ মিনার চত্বরে। শহীদ দিবস উপলক্ষে বই বিক্রির ধারণাটা তখন থেকেই।

স্বাধীনতার পর সত্তরের দশক থেকে শুধু একুশের সংকলন নয়, একুশের বইমেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ শুরু হয়, বিশেষ করে নতুন লেখকদের। সেই প্রবণতা ধীরে ধীরে দুই দশকে ব্যাপকতা অর্জন করেছে। এখন হাজারখানেক লেখক—বিশেষ করে তরুণ কবি-সাহিত্যিক—চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশ করেন। অনেক লেখক নিজেরাই প্রকাশ করেন, তবে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকেরাও নতুন লেখকদের উৎসাহিত করেন তাঁদের বই বের করে। তার ফলে একুশের বইমেলা নতুন লেখকদের পদভারে মুখরিত হয়। লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও সাধারণ মানুষের সমাগমে একুশের বইমেলা আজ দেশের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম জাতীয় ঘটনা।

বাংলাদেশের প্রকাশনাজগৎ আজ প্রাণবন্ত। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকদের সংখ্যাই তা বলে দেয়। তবে একুশের বইমেলা হরবছর কতটা বিস্তৃত হলো, কতটা বেশি জায়গায় কত বেশিসংখ্যক স্টল হলো, কত বেশিসংখ্যক নতুন বই মেলায় এল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানের দিক থেকে প্রকাশনাশিল্পের কতটা অগ্রগতি হলো। কত গুরুত্বপূর্ণ নতুন বই বের হলো, কত বেশি ক্ল্যাসিক পুনর্মুদিত হলো, ছাপা, বাঁধাই প্রভৃতির মান কতটা উন্নত। দশ-পনেরোটি প্রকাশনা সংস্থা খুব বড় হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের প্রকাশনাজগৎ একটি শিল্প।

ঢাকার প্রকাশনাজগতের বয়স কম নয়, কলকাতার চেয়ে কুড়ি-পঁচিশ বছর কম। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে সদ্ভাবশতক কাব্যগ্রন্থের কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এবং কবি ও সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মিত্র বই প্রকাশনার সূচনা করেন তাঁদের ‘মিত্র প্রকাশ’ প্রতিষ্ঠান থেকে। তখন যদি শুরু ধরি তাহলে বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতের বয়স এখন ১৬০ বছর।

৪০ বছর আগে আমি আজিমপুরে অদ্বিতীয় প্রচ্ছদশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিবেশী ছিলাম। ১৮৯০ সালের দশকের এবং কুড়ি শতকের প্রথম দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বই আমার সংগ্রহে দেখে কাইয়ুম চৌধুরী অনুরোধ করেন ঢাকার প্রকাশনাজগৎ নিয়ে কিছু একটা লিখতে। কলকাতার গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সান্‌স প্রকাশিত আমার দাদার আমলের কোনো বই নেড়েচেড়ে দেখে তিনি বাংলা প্রকাশনাজগতের ছাপা ও প্রচ্ছদ প্রভৃতির বিবর্তন ও ইতিহাস লেখার পরামর্শ দেন। বিষয়টি আমার মনঃপূত হয় এবং আমি বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, মোগলটুলী, ইসলামপুর, নবাবপুর প্রভৃতি এলাকার শতবর্ষী ছাপাখানাগুলোতে খোঁজ নিই।

ঢাকার প্রকাশনাজগৎকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায় ১৮৬০ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত। তখন ঢাকায় ১৫-২০টি ছাপাখানা ছিল। ট্রেডল মেশিনই ছিল বেশি। ফ্ল্যাট মেশিন গোটা দুই-তিন। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯০৬ থেকে ১৯৪৭, এই পর্যায়ে বেশ কিছু ভালো বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাবাজার পূর্ব বাংলার বইবাজারে পরিণত হয়। তৃতীয় পর্যায়ের সূচনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকে—১৯৪৮ থেকে ১৯৭১। চতুর্থ পর্যায়টির পরিসর ছোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সেটি ১৯৭২ থেকে ’৮০। পঞ্চম পর্যায়টির শুরু আশির দশক থেকে। এখন তা বিকশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতের যাঁরা নির্মাতা, আজ তাঁরা বিস্মৃত। আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের তাঁরা তৈরি করেছেন। পঞ্চাশের দশকে আমার আব্বার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যেতাম। বাংলাবাজার ইসলামপুরের বইদোকানগুলো ছিল প্রিয় জায়গা। সেখানে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের দেখে মুগ্ধ হতাম, যদিও আজ তাঁরা অনেকেই বিস্মৃত।

প্রকাশনাজগতের ভিত্তি শক্ত করতে কম ভূমিকা রাখেনি নওরোজ কিতাবিস্তান, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স, কোহিনূর লাইব্রেরি, পাকিস্তান বুক করপোরেশন, মখদুমী অ্যান্ড আহসানুল্লাহ লাইব্রেরি, লিয়াকত পাবলিশিং কোম্পানি, ওসমানিয়া বুক ডিপো, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, মল্লিক ব্রাদার্স, মোহাম্মদী বুক হাউস, আইডিয়াল পাবলিশার্স, স্টুডেন্ট ওয়েজ, সোবহানীয়া লাইব্রেরি, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ইস্ট বেঙ্গল বুক, সিন্ডিকেট, লিবার্টি, মওলা ব্রাদার্স, আদিল ব্রাদার্স, মুক্তধারা, বর্ণমিছিল, চট্টগ্রামের বইঘর প্রভৃতি।

কবি-সাহিত্যিকেরাও প্রকাশনা খুলেছিলেন। কাজী আফসার উদ্দিন আহমদের ছিল মৃত্তিকা সাহিত্য সংসদ, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের হাসি প্রকাশনী, আহসান হাবীবের কথা বিতান, জসীমউদ্‌দীনের নিজের বই বের করত পলাশ প্রকাশনী, কবি মঈনউদ্দীনের আলহামরা লাইব্রেরি প্রভৃতি। আমার আব্বার বাল্যবন্ধু অনিল চন্দ্র ঘোষের প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। তিনি নিজে ছিলেন লেখক।

সেকালের জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। তাদের বই ছিল উন্নত মানের। পপুলার পাবলিশার্স বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করত। ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি ছিল একটি বড় প্রকাশনা সংস্থা। একজন সরকারি আমলার উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর নাম নিয়াজ মোহাম্মদ খান। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ আইসিএস অফিসার। প্রশাসনিক দক্ষতার বাইরে সমাজকল্যাণমূলক ও গঠনমূলক কাজে তাঁর আগ্রহ ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর নামে রয়েছে ‘নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুল’। ষাটের দশকের দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কথা মনে পড়ে মতিঝিলে শ্রাবণী, ইন্দিরা রোডে কপোতাক্ষী।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কাগজপত্র থেকে দেখেছি নওরোজ, কো-অপারেটিভ বুক, প্রেসিডেন্সি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি প্রভৃতি লেখকের সঙ্গে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করতেন। সম্প্রতি আটজন খ্যাতিমান লেখককে আমি জিজ্ঞেস করেছি, প্রকাশকের সঙ্গে তাঁদের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর হয়েছে কি না। তাঁরা কেউ কেউ বলেছেন, শুধু প্রথমা প্রকাশনের সঙ্গে চুক্তিপত্র হয়েছে এবং বছরের শেষে না চাইতেই রয়্যালটির টাকা পান। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো মুক্তধারাও ৩০ চৈত্র রয়্যালটির টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিত। অন্যান্য প্রকাশকও আমাদের রয়্যালটির টাকা দেন, তবে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের ব্যাপারে গরজ কম।

লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের নিয়েই প্রকাশনাজগৎ। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জাতি গঠনে প্রকাশকদের ভূমিকা বিরাট। উন্নত দেশের প্রকাশকেরা যেসব নিয়মনীতি মানেন, আমাদের প্রকাশকেরা তা-ই অনুসরণ করবেন, লেখক হিসেবে আমাদের সেটাই প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক