কিশোরগঞ্জের পরিবেশের এই দুর্দশা কেন

জেলা শহরগুলোর পরিবেশের অবস্থা কাহিল। তবু কিশোরগঞ্জ নিয়ে মনের কোণে একটু আশা ছিল। এ জেলার ওয়েবসাইটে ‘লেক সিটি’ বলে ঘোষণা হয়তো সে আশার একটা কারণ। তা ছাড়া, প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ধরলে তিনজন রাষ্ট্রপতির জেলা শহর এটা। আওয়ামী লীগের দুজন স্বনামধন্য সাধারণ সম্পাদকেরও জেলা শহর কিশোরগঞ্জ। বরাদ্দ-নজর-বিবেচনা—এসবই নির্ভর করে সুপারিশের সুযোগের ওপর। সে সুযোগ কিশোরগঞ্জের বেশ ছিল। সে হিসাবে কিশোরগঞ্জের প্রাপ্তি সরকারি–বেসরকারি খাতে কম নয়। এ জেলায় আছে তিনটি মেডিকেল কলেজ।

কিন্তু তারপরও শহর কিশোরগঞ্জ কাঁদছে। শহরের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, রোগনির্ণয় কেন্দ্র। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা দেন। পসার জমিয়ে ফেলেন, তারপর বদলি হলে শহর ছাড়েন কিন্তু রোগী ছাড়েন না। বৃহস্পতিবার বিকেলে কি শুক্রবার সকালের মধ্যে ফিরে যান ফেলে আসা শহরে অপেক্ষায় থাকা রোগীদের কাতারে। শুক্রবার সকাল-সন্ধ্যায় বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিক থেকে রাস্তায় নেমে আসা রোগীর লম্বা কাতার দেখলেই বোঝা যায় অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, তাড়াইল, ইটনা, নিকলীর মানুষ বাঁধা পড়েছে কোনো চিকিৎসার ফাঁদে। 

ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে শহর কিশোরগঞ্জের দুঃখের একটা সরাসরি যোগ আছে। এসব ক্লিনিক-হাসপাতালের বর্জ্যের বোঝা এই শহর আর শহরবাসীকেই বহন করতে হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদীর মরা খাত এখন বর্জ্যের ভাগাড়।

কিন্তু কথা ছিল নরসুন্দার রূপ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, সাজিয়ে তোলা হবে বহমান নদীর শহর কিশোরগঞ্জকে। কেউ কেউ নদী-অন্তঃপ্রাণ মানুষদের আপত্তি উপেক্ষা করে একদা বহমান নদীকে লেক উপাধি দিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরকে লেক সিটি নাম দিয়ে ঢাকঢোল পেটাতে থাকেন। ১১০ কোটি টাকায় নেমে যায় ‘কিশোরগঞ্জ জেলার নরসুন্দা নদী পুনর্বাসন ও পৌরসভা-সংলগ্ন এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’। হাতে নেওয়া হয় নরসুন্দা নদীর ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়নকাজ। এর মধ্যে ছিল ১. হোসেনপুর উপজেলার কাউনা এলাকা থেকে সদর উপজেলার নীলগঞ্জ পর্যন্ত খনন, ২. শহরের মনীপুর ঘাট থেকে যশোদল এলাকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত নদী খনন, ৩. নদীর শহর এলাকায় তিনটি পুরোনো সেতুর সংস্কার, ৪. ছয়টি নতুন বড় সেতু, ৫. চারটি নতুন পদচারী-সেতু নির্মাণ, ৬. নদীর পাড়ে ছয় কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৭. কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা, ৮. আটটি ঘাট, ৯. দুটি বিনোদন পার্ক, ১০. একটি ওয়াচ টাওয়ার, ১১. মুক্তমঞ্চ, ১২. ফুটপাতের বিদ্যুতায়ন, ১৩. পথচারী-শেড নির্মাণসহ নদীপাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন।

জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভা যৌথভাবে কাজটি শুরু করে ২০১২ সালে। কিছুদিনের মধ্যেই লুটপাটের গুঞ্জন শুরু হয়। এর মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে। এরপর লুটপাটের কথিত ‘কানকথা’ কিছুটা আমলে নেয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনজন সচিব কিশোরগঞ্জে গিয়ে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করেন (গণশুনানি)। সেই শুনানির সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক, নৌপরিবহনসচিব অশোক মাধব রায় ও রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব সম্পদ বড়ুয়া। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ও পরিবেশ আন্দোলনকারীদের চাপে শেষ পর্যন্ত একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারা কয়েকবার সরেজমিন পরিদর্শন করলেও তদন্ত প্রতিবেদনের হাল অবস্থা কিশোরগঞ্জের কারও জানা নেই।

কিশোরগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম) সভাপতি অধ্যক্ষ শরীফ সাদী বললেন, ‘আমরা লেক চাই না, নদী চাই। নদী খুঁড়ে লেক বানালে কিশোরগঞ্জ বাঁচবে না। খননের নামে যা করা হয়েছে, তাতে আগের অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প পরিকল্পনা বা ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান (ডিপিপি) অনুসরণ না করে ভুলভাবে টাকা খরচের কাজ করার অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানান।

নরসুন্দা খুদলেই কি জলপ্রবাহ বাড়বে?

পুত্রবধূকে এক ক্লিনিকে চিকিৎসায় নিয়ে আসা ইটনার কাশেম গাজী মাগরিবের নামাজ পড়তে এসেছিলেন পাগলা মসজিদে। নামাজ শেষে আমাদের আলোচনা জমে ওঠে। বলেন, ইটনা উপজেলার বাদলার কাছে নরসুন্দা যেখানে ধনু নদের সঙ্গে মিশেছে, সেটায় ‘চৌগাংগা’। বলেন বারুনী নদীর কথা। নেত্রকোনা জেলার সীমানা পেরিয়ে বারুনী নদী ইটনা ও তাড়াইল উপজেলার সীমানা বরাবর কিশোরগঞ্জে ঢুকে মিশে গিয়েছিল নরসুন্দার সঙ্গে। নদীর সঙ্গে নদী মেশে সাগরে যাওয়ার ফন্দিতে। গানের মতো কথা কাশেম গাজীর। পয়সা হারালে রাস্তায়, আর খোঁজো টাকা আলোর নিচে। নরসুন্দা নিয়ে এমন মারফতি কথা আগে শোনা হয়নি। এখানকার নরসুন্দা খুঁড়ে ফানা ফানা করে দিলেও পানিতে ভরবে না নরসুন্দা। কাওনায় দিয়েছ ফারাক্কা আর পানি চাও এখানে? পাকিস্তান আমলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (তখনকার ওয়াপদা) কিশোরগঞ্জ শহরের উজানে হোসেনপুরের কাওনা এলাকায় নরসুন্দার উৎসমুখে বাঁধ দেওয়ার ফলে নদীটি তখনই তার নাব্যতা হারাতে বসে। সে বাঁধের একটা বিধি-ব্যবস্থা না করলে নরসুন্দা যে জলহীন থাকবে, সে কথা নরসুন্দা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সুধী সমাজের অজানা নয়। জানেন না শুধু কর্তারা। 

একদা পালতোলা নৌকার গুন (নৌকায় ইঞ্জিন বসানোর আগে উজানে নৌকা নেওয়ার সময় নৌকার মাস্তুলে বাঁধা দড়ি টেনে বা গুন টেনে যাঁরা নৌকাকে সামনে নিতে দাঁড়ীদের সাহায্য করতেন, তাঁদের কোথাও কোথাও গুন বলা হতো) ইটনার কাশেম গাজী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা সব চেনেন। তাঁর মতে, সমস্যা আরও ওপরে, শুধু কাওনা কাটলে হবে না, জামালপুর-গাইবান্ধায় কাজ করতে হবে। এরেনডাবাড়ি মানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের মুখের বালি ছোটাতে না পারলে নরসুন্দাকে কেবল বৃষ্টির জলে পা ভেজাতে হবে। নাও ভাসানো যাবে না। 

দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের পাশাপাশি কাশেম গাজীর মতো নদী চেনা নদী জানা নদীবন্ধু সাধারণ মানুষের কথা নদী ব্যবস্থাপকদের আমলে নিতে হবে। নদীকে সাগরের কাছে যাওয়ার রাস্তা খুলে না রাখলে সাগর–নদী–সভ্যতা কোনোটাই টিকবার নয়।

গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক
nayeem [email protected]