সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তেমন চেষ্টা বা সাফল্য—কোনোটিই দৃশ্যমান নয়। এমনকি সংসদ প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনটি কার্যকর হওয়ার পরে তার প্রয়োগে সংশ্লিষ্টদের আমরা তৎপর হতে দেখিনি। সর্বশেষ হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ পেট্রলপাম্পগুলোকে ফিট না থাকা গাড়িকে তেল না দিতে এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তত্ত্বাবধানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই টাস্কফোর্স গঠন করা হলেই সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ফিরে আসবে, তেমন ভাবনা সহজ নয়। 

বিশেষজ্ঞরা আদালতের সর্বশেষ নির্দেশনাকে নীতিগতভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ, আদালতের নির্দেশনায় মহাসড়কগুলোতে বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতি বদল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন, বিশ্বের দেশে দেশে ফিটনেসের মতো বিষয় কেবল রেগুলেটরি সংস্থাগুলোই দেখে থাকে। বাংলাদেশের বিদ্যমান কাঠামোতেও তাই আছে, আদালত এখন যা ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করে বাস্তবায়ন করতে চাইছেন, সেটা করার মূল দায় বিআরটিএর। এই সংস্থারও জেলা পর্যায়ে নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য খুবই কম। ৪০ লাখের বেশি গাড়ি ব্যবস্থাপনায় সংস্থাটির লোকবল ৮০০, তার মধ্যে ২০০টি পদই শূন্য। প্রতিটি জেলায় একজন পরিদর্শক। মোট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ১০ জন। 

আসলে শুধু রাজধানী ঢাকা সামলাতেই ১০ ম্যাজিস্ট্রেট ও ৮০০ লোক অপ্রতুল। অথচ এটা সবারই জানা যে এই খাত থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করছে। লোকবল কম থাকার কারণে সেবা পেতে জনগণকে অব্যাহতভাবে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সংস্থাটি আদালতকে বলেছে, দেশে অন্তত চার লাখ ফিটনেসবিহীন যান চলছে। বর্তমান সামর্থ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অনেকটাই অসম্ভব। সুতরাং আমরা আশা করব, সংস্থাটি যাতে স্থায়ীভাবে সামর্থ্য বাড়াতে পারে, সে জন্য আদালত স্থায়ী কিছু পদক্ষেপ নিতে সরকারকে বাধ্য করবেন। ডিসি, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট তাদের সবারই বদলির চাকরি। পাকাপাকিভাবে সড়ককে জঞ্জালমুক্ত রাখার দায়িত্বটা বিআরটিএকেই নিতে হবে।

হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি ও সেপ্টেম্বরে আরও ৫ জেলার মহাসড়ক থেকে ইঞ্জিনচালিত নছিমন, করিমন ও ভটভটি প্রত্যাহার করতে ডিসিদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বাস্তবে তা তামিল হয়নি। ফিটনেসহীন ও অনুপযোগী যান মহাসড়কে চলাচলের বিষয়টিকে শুধু আইনের জায়গা থেকে দেখলেই চলবে না। তার কারণ, এ ধরনের যান প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণপরিবহন হিসেবে মানুষ লুফে নিয়েছে। এটা বন্ধ করতে হলে বিকল্প কিছু হবে। সে জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেখানে যান মালিকদের ঋণ সুবিধা, চালকদের প্রশিক্ষণ এবং পার্শ্ব মহাসড়ক নির্মাণ করার মতো বিষয়গুলো থাকতে হবে। 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে দেশে কত কিছুই ঘটে গেল, কত রাজনীতি হলো, কত বিচিত্র উপায়ে হিসাব-নিকাশ হলো, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হলো, অথচ সড়কগুলোতে নৈরাজ্য অব্যাহত। এমনকি প্রাথমিক পরিসংখ্যান নির্দেশ করছে যে পরিস্থিতি অবনতিশীল। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে সড়কে নিহত হয়েছিল ৪০০ জনের কম। কিন্তু এক বছর ব্যবধানে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নিহতের সংখ্যা ৪৫০ ছুঁই–ছুঁই। এসবই নির্দেশ করছে যে পরিবহন খাতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। হাইকোর্টের চলমান মামলাটি স্বপ্রণোদিত, তাই এর আওতায় আরও অগ্রগতি প্রত্যাশিত।