রোগের নিরাময় হবে নাকি সংক্রমণ বাড়বে?

আর্থিক খাতসংক্রান্ত নীতিগত পরিবর্তনগুলো দেখে ইদানীং এই কথা বারবার মনে আসে। যে পথে খাতটি চলছে, তাতে রোগের নিরাময় হবে নাকি সংক্রমণ বাড়বে?

ছয়–নয় নিয়ে বিতর্ক শেষ হইয়াও হয় না শেষ। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল প্রচলিত সুদের হার অনেক উঁচু। বিনিয়োগ এতে বাধাগ্রস্ত হয়। তাই ঋণের ওপর সুদের হার কমাতে হবে। কে কমাবে? অবশ্যই ব্যাংকাররা; কারণ, ব্যাংক ছাড়া বাংলাদেশে ঋণ মোটাদাগে আর কোথাও থেকে পাওয়া যায় না। ব্যাংকাররা ঋণ দেন আমানতের অর্থ থেকে। সেই অর্থ সংগ্রহ করতে সুদ দিতে হয় আমানতকারীদের। কাজেই ব্যাংকঋণের সুদ কমাতে হলে আমানতের সুদও কমাতে হবে। 

বিপদ শুরু এখানে। ব্যাংক থেকে সুদ কমে গেলে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখতে আগ্রহী হবেন কেন? বিশেষ করে তাঁদের কাছে যদি বিকল্প থাকে। তাঁরা সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন, যেখানে সুদের হার ৬ শতাংশের বেশি। সমস্যা হলো সরকার গত ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর কিছু কড়াকড়ি আরোপ করার ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ কমে গেছে। আরেকটি বিকল্প ছিল ডাকঘর স্কিম। সেটার ওপরও সুদের হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্য বিকল্প শেয়ারবাজার। সেখানে কিন্তু ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই সাধারণ এবং বিশেষ করে ছোট সঞ্চয়কারীদের জন্য এটা বাস্তব বিকল্প নয়। কাজেই ব্যাংক ছাড়া যাবেন কোথায়? 

ব্যাংক আমানতের ওপর ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া যাবে না। মূল্যস্ফীতি যেখানে ৬ শতাংশের কাছাকাছি, সেখানে এই ৬ শতাংশ অবশ্যই অনেক কম। তাই প্রশ্ন, বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিতে আমানতকারীদের মূল্য দিতে হবে কেন? পাল্টা প্রশ্ন, আমানতের সুদ না কমিয়ে ঋণের সুদ কমানো কি সম্ভব? সেটা দুভাবে হতে পারে। এক, ব্যাংকাররা যদি লোকসান সামাল দিতে পারেন, পরিচালন ব্যয় কমাতে পারেন অথবা মুনাফায় ছাড় দেন আর দুই, সরকার যদি ভর্তুকি দেয় আমানতকারী বা ঋণগ্রহীতা বা ব্যাংকারদের।

ব্যাংক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। লোকসান দিয়ে তো তারা ব্যবসা করবে না। মুনাফার ক্ষেত্রে কি ছাড় দেবে? কতটা ছাড় যৌক্তিক? খরচ কতটা কমাতে পারবে? কে সেটা নির্ধারণ করবে? সব ব্যাংক তো একই ধরনের ঋণ ব্যবসা করে না। সবার মুনাফার মাত্রাও তাই এক নয়। পরিচালন খরচও ভিন্ন। কোন ব্যাংকের জন্য কোন মাত্রার মুনাফা যৌক্তিক, সেটা বোঝার উপায় কী? সরকারের কি সেটি সঠিক অনুমান করার সক্ষমতা আছে? 

ভর্তুকি দিয়ে কি পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব? কাকে কত কীভাবে দেওয়া যায়? সেটাই–বা কীভাবে নির্ধারিত হবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ভর্তুকির যৌক্তিকতা কী? বাজার ব্যর্থতা সংশোধন নাকি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস? যদি বাজার ব্যর্থতা সংশোধন হয়ে থাকে, তাহলে ভর্তুকি কেন? কারণ, বাজার ব্যর্থতা সংশোধন করার জন্য ভর্তুকির ব্যবহার মানে আমরা ধরে নিচ্ছি, বাজারের নির্ধারিত মূল্যটি যথেষ্ট নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারই আমানতের ওপর যেই সুদ বাজার দিচ্ছিল, তা কমিয়ে দিয়েছে। তাহলে আবার ভর্তুকি দেওয়ার প্রশ্ন আসে কীভাবে? অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস যদি যুক্তি হয়ে থাকে, তাহলে তো ভর্তুকি শুধু গরিব আমানতকারীদের দেওয়ার কথা, সব আমানতকারীদের নয়। ব্যাংকারদের তো অবশ্যই নয়। 

যেকোনো বাজারে মূল্যের সীমা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দিলে এ ধরনের নানান প্রশ্ন উঠে আসে। তার মৌলিক কারণ হলো, ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বার্থ সব বাজারেই পরস্পরবিরোধী। ক্রেতার জন্য মূল্য যত কম ততই বেশি। বিক্রেতার জন্য যত বেশি ততই কম। ক্রেতা–বিক্রেতা দুই পক্ষের নীতিগতভাবে আরোপিত একই মূল্য দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা একেবারেই অসম্ভব। বিষয়টা সন্তুষ্টির নয়, সমন্বয়ের। এবং এই সমন্বয়টি শুধু বাজারই সব অংশীজনের গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে করতে পারে। 

সুদের হারের কথাই ধরুন। যেকোনো অর্থনীতিতে সুদের হার কত হবে, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতির ভাষায় এক, অর্থের চাহিদা আর দুই, অর্থের সরবরাহ বা জোগান। অর্থের চাহিদা ব্যবসায়ী, সরকার এবং সাধারণ ভোক্তার কাছ থেকে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য যত চাঙা থাকে, ব্যবসায়ীদের অর্থের চাহিদা তত বেশি হয়ে যায়, সরকারের বাজেট ঘাটতি যত বাড়ে, সরকারি চাহিদাও তত বেড়ে যায়, ভোগবিলাসিতা বাড়লে ভোক্তার অর্থ চাহিদা বেড়ে যায়। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, সার্বিক অর্থ চাহিদা বাড়লে সুদের হার বেড়ে যায়।

অর্থের জোগান বাড়ে যখন ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী বা সরকারি সঞ্চয় বাড়ে অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করে। অর্থ সরবরাহ যত বেশি হবে, সুদের হার ততই কম। অর্থের চাহিদা এবং জোগান সব সময় এবং সব ক্ষেত্রে এক হয় না।

ঋণদাতারা ঋণ দিতে কতটা আগ্রহী হয়, তা আংশিকভাবে মূল্যস্ফীতির হারের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ধরুন, মূল্য স্থিতিশীল হওয়ার প্রত্যাশা করে আমি এক বছরের জন্য ৪ শতাংশে ঋণ দিতে পেরে খুশি হতে পারি। কারণ, বছরের শেষের দিকে আমার ৪ শতাংশ বেশি ক্রয়ক্ষমতা থাকবে বলে আশা করি, যা কিনা বিকল্প অন্য ঋণের চেয়ে বেশি। এখন মনে করুন, মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে আমি ১৪ শতাংশ হারে সুদ পেতে চাইব, যার ১০ শতাংশ পয়েন্ট আমাকে মুদ্রাস্ফীতির জন্য ক্ষতিপূরণ দেবে। অর্থনীতিবিদ আরভিং ফিশার এক শতাব্দী আগে এই সত্যটি দেখিয়েছিলেন, সুদের আসল হার (ওপরের উদাহরণে ৪ শতাংশ) = সুদের নামমাত্র হার (ওপরের উদাহরণে ১৪ শতাংশ) – মুদ্রাস্ফীতি (ওপরের উদাহরণে ১০ শতাংশ)। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র ১৪ শতাংশই ক্রয়ক্ষমতাকে ৪ শতাংশ বাড়াতে পারে। 

ঋণগ্রহীতার ঝুঁকি আরেকটি নির্ধারক। আমি আমার সরকার বা আমার স্থানীয় ব্যাংকে ঝুঁকিপূর্ণ নতুন উদ্যোগকে দেওয়ার চেয়ে কম হারে ঋণ দিতে আগ্রহী হব। আমার ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ করা হবে না—এমন ঝুঁকি যত বেশি হবে, তত বেশি সুদের হারটি আমি সেই ঝুঁকির কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য দাবি করব। সুতরাং, ঋণগ্রহীতার পুরোপুরি ঋণ পরিশোধ না করার ঝুঁকিটি যত বেশি, সুদের হার তত বেশি।

সুদের হার ঋণের সময়কালের ওপরও নির্ভর করে। সাধারণভাবে, ঋণদানকারীরা দীর্ঘ মেয়াদের ঋণের জন্য সুদের উচ্চ হারের দাবি করে। ১০ বছরের ঋণের সুদের হার সাধারণত এক বছরের ঋণের চেয়ে বেশি হয়, এবং আমানতের তিন বছরের ব্যাংক সার্টিফিকেটে যে হার আমি পেতে পারি, তা সাধারণত আমানতের ছয় মাসের হারের চেয়ে বেশি হয়। 

সর্বশেষে তবে সর্বনিম্ন নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতি আর্থিক বাজারগুলোতে চাহিদা এবং সরবরাহের অবস্থাকে এবং এর ফলে সুদের হারকেও প্রভাবিত করে। একইভাবে সরকারের বাজেট নীতিমালাও। 

এসব বিষয় উপেক্ষা করে সব ঋণের জন্য একটি সুদের হার বেঁধে দেওয়া মোটেও যৌক্তিক নয়। আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসব আমলে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, মাঠপর্যায়ে থেকে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা যেভাবে চাহিদা ও জোগান পরিস্থিতিকে অনুভব করতে পারেন, আমলাদের তা বোঝার যোগ্যতা বা ক্ষমতা নেই।

তাহলে সুদের হার কে স্থির করবে? অন্য জিনিসগুলোর মতো সরবরাহ ও চাহিদা একটি বড় ভূমিকা পালন করে; কত লোক ঋণ নিতে চায় এবং কত লোক ঋণ দিতে চায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারের ওপরে অনেক প্রভাব রয়েছে। সরকারি ঋণ কেনাবেচা করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সরবরাহ এবং চাহিদা পরিবর্তন করতে পারে এবং সুদের হারকে ওপরে বা নিচে ঠেলাঠেলি করতে পারে। এই কৌশল মুদ্রানীতির অংশ। 

সুদের হারের নীতির প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বসহকারে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমানতের আসল হার বেশ কয়েক বছর ধরে নেতিবাচক ছিল। ফলে ব্যাংক আমানতের বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান ঋণখেলাপির মুখে ধীরে ধীরে বর্ধমান আমানত ব্যাংকগুলোর জন্য তারল্য এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে লোকসানের সমস্যা তৈরি করে আর্থিক খাতের প্রসার এবং স্থিতিশীলতার ক্ষতি করতে পারে, যা অবশ্যই এড়ানো উচিত।

নির্দিষ্ট ঋণগুলোতে প্রদত্ত সুদের হার এই জাতীয় ঋণসম্পর্কিত ঝুঁকি, ঋণ সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে বাজারকে নির্ধারণ করতে দেওয়া উচিত। সরবরাহ, চাহিদা এবং ঝুঁকি প্রোফাইল আমলে নেওয়া ছাড়াই একক সুদের হারের সিলিং নির্ধারণ করা ঋণ বরাদ্দে মারাত্মক অদক্ষতা তৈরি করে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলো, বিশেষ করে কুটির, মাইক্রো এবং ছোট উদ্যোগ ঋণবঞ্চিত হতে পারে। এই জাতীয় আর্থিক দমন এড়াতে হবে। নিয়ন্ত্রণভিত্তিক ও প্রশাসনিকভাবে নির্ধারিত সুদের হার নীতি অনুসরণ করার পরিবর্তে আমাদের উচিত একটি উপযুক্ত বাজারচালিত সুদের হার নীতিতে ফিরে যাওয়া এবং আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। 


জাহিদ হোসেন অর্থনীতিবিদ