একুশের ব্যানারে প্লাস্টিক-পিভিসি বর্জিত হোক

সিটি নির্বাচনের পর এ ধরনের প্লাস্টিক অথবা পিভিসির ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারি একুশের উদ্‌যাপনে। ছবি: প্রথম আলো
সিটি নির্বাচনের পর এ ধরনের প্লাস্টিক অথবা পিভিসির ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারি একুশের উদ্‌যাপনে। ছবি: প্রথম আলো

রাত পেরোলেই একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সেই দিনগুলোয় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ছিল, ছিল হার না-মানা একরাশ স্বপ্ন আর ছিল পরিবর্তনের অঙ্গীকার। আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে তখন ছাত্রজনতার হাতে শোভা পেত ব্যানার কিংবা প্ল্যাকার্ড। ছাত্ররা রাত জেগে চাটাই কেটে তাতে আঠা দিয়ে কাগজ সেঁটে রচনা করত স্লোগান। কাপড়ের ওপর হাতে লিখে তৈরি করা হতো ব্যানার। তাই সেসব ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু কাপড়ে কিংবা কাগজে হাতে লেখা সেই দৃঢ়সংকল্পগুলো ছিল হৃদয় থেকে উৎসারিত এবং সাংস্কৃতিকভাবে টেকসই। তাই সেই প্ল্যাকার্ড, ব্যানার কিংবা ফেস্টুনের কাপড় বা কাগজগুলো ক্ষয়ে গেলেও সেই বাণীগুলো রয়ে গেছে। ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’, ‘আমার ভাষা, তোমার ভাষা, বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’, কিংবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানগুলোর মৃত্যু হয়নি আজও; আর হবে না কোনো দিনও। কারণ, এগুলো ইতিহাস হয়ে গেছে।

সেই সময়ে ব্যানার কিংবা পোস্টারের স্থায়িত্ব নিয়ে কেউ ভাবত না। গণমানুষের ভাগ্যের স্থায়ী পরিবর্তনই ছিল লক্ষ্য। সময় আজ বদলেছে। আমাদের এখনকার জনপ্রতিনিধিরা ব্যানার কিংবা পোস্টারের স্থায়িত্ব নিয়ে যতটা ভাবেন, তার কিয়দংশ যদি জনগণের ভাগ্যের স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য ভাবতেন, তবে এই দেশ স্বর্গভূমিতে পরিণত হতো। সম্প্রতি পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী অভাবনীয় এক নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার সাক্ষী হতে হয়েছে ঢাকাবাসীকে। ঢাকার আকাশ ছেয়ে গেছে প্লাস্টিকের শামিয়ানায়, ঢাকার ফুটপাতে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েছে হাজার হাজার নির্বাচনী পোস্টার। একন চলছে মুজিব বর্ষের ক্ষণগণনা। চারদিক ছেয়ে গেছে পিভিসি ব্যানারে। জানি না, মুজিব বর্ষ শেষ হতে হতে কী পরিমাণ পরিবেশদূষণকারী প্রচার–প্রচারণার উপকরণ উৎপাদন ও বিতরণ করা হবে! জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর নেতৃত্বে এ দেশের জন্ম হয়েছিল, তিনি কিছুতেই মেনে নিতেন না পরিবেশ নষ্টের এসব উদ্যোগ।

ব্যানারগুলো আজ আবার সেজে উঠবে। দিকে দিকে শোভা পাবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের আয়োজনসংবলিত নানান ব্যানার, পোস্টার কিংবা ফেস্টুন। আগামীকাল প্রভাতফেরির যাত্রীদের পথের সঙ্গী হবে হাজার হাজার পিভিসি ব্যানার। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মহান উদ্দেশ্য ছাপানো ব্যানার কি বাংলার প্রকৃতি-পরিবেশ ও সৌন্দর্যবান্ধব? সেই ব্যানারগুলোর ব্যবহার হবে অল্প সময়ের জন্য। পুষ্পস্তবক অর্পণকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশের উদ্দেশ্যে রচিত এসব ব্যানার। কয়েকখানা ছবি, সেলফি কিংবা ওয়াচ পার্টি শেষ হলেই এদের আশ্রয় হবে বস্তিঘরের চালে, ময়লার ভাগাড়ে কিংবা জলাশয়ের তলদেশে। আর নষ্ট করে যাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ। এসব পিভিসি তথা প্লাস্টিকের ব্যানার পচবে না, নষ্ট হবে না; কিন্তু নষ্ট করে যাবে চারপাশ।

আজকাল এসব দিবস এলেই বড্ড ভয় হয়। এসব দিবস মানেই টনে টনে অপচনশীল উপকরণ, উৎপাদন ও তার ব্যবহার। আমরা কি একটু অন্যভাবে ভাবতে পারি না? আমরা কি ফিরে যেতে পারি না কাপড়ের তৈরি সেবব ব্যানারের দিনে? আমরা কি আবার হাতে লেখা ব্যানার নিয়ে প্রভাতফেরির মিছিলে যোগ দিতে পারি না? হয়তো এতে ব্যানারের চাকচিক্য থাকবে না, কিন্তু প্রকৃতি তো তার চাকচিক্য ফিরে পাবে। একবার ভাবুন তো, কয়েক দিন আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় আমরা যারা প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার ব্যবহারের জন্য প্রার্থীদের গালমন্দ করেছি, আজ ব্যানার তৈরির সময় আমরা কয়জন নিজেরা পরিবেশবান্ধব ব্যানার তৈরির কথা ভেবেছি? মুজিব বর্ষে আমরা কি পারি না প্লাস্টিক দূষণে দূষিত আয়োজন থেকে নিজেদের বিরত রাখতে? আমরা চাই পরিবেশদূষণমুক্ত হোক মহান ভাষা দিবসসহ প্রতিটি আয়োজন। আমরা চাই আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর বিখ্যাত কবিতা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে বর্ণিত রাতজাগা চাঁদ বারবার চুমু খাক নীল গগনের বসনে। কোন ধোঁয়া আর দূষণ যেন ঢেকে না দেয় ফাল্গুনরাতের চাঁদের উজ্জ্বল শোভা আর একুশের বিষাদ।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]