নাগরিকদের ওপর নজরদারি আর কত দিন?

পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে প্রায়ই মন্তব্য পড়ি ও শুনি—দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন—অনেক কিছুই বলা যায় না, লেখা যায় না। গণমাধ্যমে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে শুনি—তাঁরা একধরনের সেলফ সেন্সরশিপের কুঠুরিতে বন্দী হয়ে পড়েছেন। পাঠকের অভিযোগ—পত্রিকাগুলো কেমন যেন পানসে, ম্যাড়মেড়ে হয়ে পড়ছে। কোথায় যেন ঘাটতি।

মূলধারার গণমাধ্যমে যা আসে না, তা আকারে ও প্রকারে পল্লবিত হয়ে ফুটে ওঠে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। এই মাধ্যমে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ফেসবুক। ফেব্রুয়ারি হলো আমাদের ‘ভাষার মাস’। ফেসবুকের বাংলা তরজমা করার জন্য অনেকেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। এটা না হলে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নাকি থাকে না। আমার এক বন্ধু এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘অবয়বপত্র’ চালু করেছেন। এটি তৎসম শব্দ, বাংলা নয়। অক্ষরও বেশি। ছোটবেলায় আমরা স্কুলে পড়েছি—চেয়ারের বাংলা হলো আরাম কেদারা। কোনো মানে হয়? চেয়ার এখন বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে। টমেটোকে এখন কেউ আর বিলাতি বেগুন বলেন না। ফেসবুকও এখন আমাদের হয়ে গেছে।

ফেসবুকে সবাই স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন। ওখানে খবরদারি চলে না। যদিও বেশির ভাগ কনটেন্টই মিথ্যা, গুজব ও গালাগালে ভরা, অনেক সত্যিও সেখানে উঠে আসে। আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ফেসবুকে যে তথ্য এসেছে, মূলধারার গণমাধ্যম সেটি গ্রহণ করেছে একটু দেরিতে। দেরিতে হলেও তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। এর ফলে ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ আরও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ফেসবুককে বিটিভির মতো ‘জি-হুজুরের বাক্স’ বানানোর আবদার ও খায়েশ আছে কারও কারও মনে। তবে সেটি সম্ভব হবে না। আমরা আড্ডায় বসে অনেক কিছু বলি। এর মধ্যে প্রলাপ, গুজব, গিবত—এসব অনেক কিছুই থাকে। আবার দরকারি কথাও থাকে। ফেসবুকও তা-ই।

যাঁরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সব জায়গায় খবরদারি করতে না পারলে যাঁদের পেটের ভাত হজম হয় না, ফেসবুকে তাঁদের অস্বস্তি। তাঁরা শুধু গুজবটাই দেখেন, সত্যিটা দেখেন না। যখন ফেসবুক ছিল না, তখন মূলধারার খবরের কাগজগুলোতেও গুজব ছড়ানো হতো। এখনো হয়। অমুক গ্রামে আমগাছের ডাল থেকে দুধ বেরোচ্ছে—এটি দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসছে। কয়েক বছর আগে মুম্বাইয়ে কোনো এক মন্দিরে গণেশের শুঁড় থেকে অবিরাম দুধ বেরোচ্ছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। এখনো অনেক লোকের বিশ্বাস, পানি পড়ায় অসুখ সারে। পশ্চাৎপদ সমাজে এগুলো আছে, থাকবে।

কথায় আছে, দুরাত্মার ছলের অভাব নেই। যাঁরা দেশটাকে নিজেদের তালুক মনে করেন, তাঁরা সব সময় সবকিছুর ওপর মাতবরি করতে চান। একটা গ্রাম্য সমাজ থেকে আমরা একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠছি। রাষ্ট্র একটি ইউরোপীয় কনসেপ্ট। ইংরেজ-ঔপনিবেশিক-দখলদারদের হাত ধরে আমাদের এই বিবর্তন। কিন্তু গ্রাম্য মাতবরদের স্বভাব আমরা এখনো ছাড়তে পারিনি। কার সঙ্গে কার বিয়ে হবে, সড়ক কোন দিক দিয়ে কার বাড়ির আঙিনা ফুঁড়ে তৈরি হবে, গ্রামে বাইরে থেকে কেউ এলে তার তত্ত্ব-তালাশ কে নেবে, কোনটা জায়েজ আর কোনটা নাজায়েজ, এই ফতোয়া কে দেবে—এসব হলো মাতবরের এখতিয়ার। আমাদের রাষ্ট্রও এ রকম হয়ে উঠেছে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না—সব সময় চোখরাঙানি।

পাকিস্তান আমলটা এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ দেখেনি। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের জন্ম একাত্তরের পরে। পাকিস্তান আমলের ২৩-২৪ বছর ফাটা রেকর্ডে একই গীত শুনেছি—স্বাধীনতা বিপন্ন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মননে বিদেশি এজেন্ট। আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী একবার স্টকহোমে শান্তি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। এটা ১৯৫৪ সালের শেষ দিকের কথা। ফেরার সময় তিনি শুনলেন, দেশে ফেরা বিপজ্জনক। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি কলকাতায় টাওয়ার হোটেলে বসে থাকলেন মাসের পর মাস। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর হস্তক্ষেপে একটা সুরাহা হলো। ভাসানী ঢাকায় ফিরে এলেন।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে শেষ অবধি পাকিস্তানের শাসকেরা বিরোধী দল সম্পর্কে যে অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করতেন, তা এখনো চালু আছে। এটা একধরনের পাকিস্তানবাদ।

স্কুলে পড়ার সময় লুকিয়ে মাঝেমধ্যে আকাশবাণীর খবর শুনতাম। সেখানে দেখতাম, বিরোধী দলের সংবাদও পরিবেশন করা হতো। শুনে খটকা লাগত—রেডিওতে বিরোধী দলের খবর! পাকিস্তানে তো এটা ছিল কল্পনাতীত। পাকিস্তানের সে ঐতিহ্য বিটিভি এখনো ধরে রেখেছে।

ইংরেজ আমলে এ দেশে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের জেলে আটক রাখা হতো। তাঁরা যেসব চিঠি পাঠাতেন বা বাইরে থেকে স্বজনেরা যেসব চিঠি দিতেন, জেল কর্তৃপক্ষ সেসব আগে পড়ে দেখত, ওটা সেন্সর করা হতো। অনেক চিঠিই প্রাপকের কাছে পৌঁছাত না। ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল টাঙ্গাইলে প্রাদেশিক পরিষদের একটি আসনে উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন শামসুল হক (দুই মাস পর তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন)। এই উপনির্বাচনে মাওলানা ভাসানীর সই জাল করে ইশতেহার বিলি করে অসদুপায় অবলম্বন করা হয়েছে, এ অজুহাতে শামসুল হকের বিরুদ্ধে একটি আদালতে নির্বাচনী মামলা করা হয়। ভাসানী ওই সময় আসামে তাঁর মুরিদদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে ধুবড়ি জেলে আটক ছিলেন। ইশতেহারে ভাসানীর সইয়ের সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিল না। বছরখানেক ধরে মামলা চলে এবং আদালত শামসুল হকের নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। (সূত্র: আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব, মহিউদ্দিন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন)।

এখন তো মনে হয় পুরো দেশটাই জেলখানা। টেলিফোনে আড়ি পাতা হয়। কয়েক বছর আগে বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয়েছিল। এরপর আরও অনেকের টেলিফোন সংলাপ আমরা টেলিভিশন চ্যানেলে শুনেছি। শাসক দলের কেউ এখন পর্যন্ত ধরা খাননি। এতে মনে হয়, তাঁরা টেলিফোন ব্যবহার করেন না। তো বিষয়টা হলো টেলিফোনে আড়ি পাতা। অনেকেই এখন বলেন, ‘ভাই, হোয়াটসঅ্যাপ আছে? ওটায় কথা বলবেন।’ শুনেছি হোয়াটসঅ্যাপ নাকি নিরাপদ, আড়ি পাতা যায় না।

আমাদের সংবিধানের ৪৩ ধারায় আছে—‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ—সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষর অধিকার থাকিবে।’ কথা হলো, রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তাহলে কী করার আছে? ভক্ষকের তো একটাই অজুহাত—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে।

বাংলাদেশে একটি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে। অপরাধ কার্যক্রমের ওপর নজরদারির নামে এটি নানাভাবে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে। টেলিফোনে আড়ি পাতা তাদের একটি কাজ। অজুহাত হলো জঙ্গি তথ্য সংগ্রহ করা। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে এটিকে আরও ‘সক্ষম’ করে তোলা হয়েছে। (সূত্র: বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৮ জুন ২০১৭)।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে বেলা তিনটায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে এক বিবৃতিতে সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক্‌স্বাধীনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এই সংসদের সদস্য। কিন্তু আপনারা শুনে অবাক হবেন যে আমাদের সব চিঠিই সেন্সর করা হয়। আমাদের আত্মীয়-স্বজন অথবা মন্ত্রীদের সকল চিঠিই করাচিতে সেন্সর করা হয়। আমরা কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমাদের টেলিফোনে আড়ি পাতা হয়।...আমি ভুগেছি। আমি জানি তারা এসব বিষয়ে কী করে।...আপনি কি জানেন যে পূর্ববঙ্গে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপতে পারবেন না; আপনারা ওটা ছাপতে পারবেন না।’ ...

আমরা কি এখনো সেই আগের জায়গাতেই আছি? আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গলা ফাটাচ্ছি?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]