কর্তৃত্ববাদের দশ লক্ষণ

‘অথরিটারিয়ানিজম’ শব্দটার বাংলা অর্থ করা হয়েছে কর্তৃত্ববাদ। অভিধান ধরে খুঁজতে গেলে অর্থ দাঁড়ায় কোনো দল বা ব্যক্তির শাসন, যেখানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা মতামতের কোনো মূল্য নেই। সোভিয়েত কমিউনিজমকে আমরা কর্তৃত্ববাদী বলতে পারি, একজন স্তালিন বা কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে অনায়াসে ব্যক্তির অধিকার বা স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদের প্রকাশ ঘটেছে প্রবল ক্ষমতাধর শাসকের উত্থানের ভেতর দিয়ে। ফিলিপাইনের দুতার্তে, তুরস্কের এরদোয়ান, হাঙ্গেরির উরবান অথবা উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উন ঠিক যে রকম ক্ষমতাধর শাসক। এই তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

লক্ষ করুন, এই তালিকায় কোথাও কোনো সামরিক শাসকের নাম নেই। সামরিক শাসন মানেই হলো অশাসনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ফলে চরিত্রগতভাবে সে কেবল কর্তৃত্ববাদীই নয়, স্বৈরতান্ত্রিকও বটে। কিন্তু যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের কথা আমরা বলছি, তার একটি পোশাকি গণতান্ত্রিক চেহারা রয়েছে। দুতার্তে বা এরদোয়ান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন, আইন পরিষদে তাঁদের অনুগত সমর্থকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, রাজনৈতিকভাবে তাঁরা রীতিমতো জনপ্রিয়। একদিকে নিজেদের গণতান্ত্রিক ছাপ, অন্যদিকে জনপ্রিয়তা—এই দুই পরিচয় ব্যবহার করে তাঁরা বা যেকোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারপ্রধান দেশটাকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারেন। প্রয়োজনে শাসনতন্ত্র বদলাতে পারেন, আইন পরিষদে নিজের সমর্থন ব্যবহার করে নতুন আইন বানাতে পারেন, যদি কেউ ঝামেলা পাকাতে চান তাহলে নির্বিঘ্নে জেলে পুরে দিতে পারেন। পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদী হলে শুধু জেলে পোরা নয়, চাইকি দিনেদুপুরে খুন করেও পার পেয়ে যাওয়া যায়।

এত দিন ভাবা হতো কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশেই সম্ভব। সে ভাবনা বদলেছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উদাহরণ দিয়ে বলা হচ্ছে, ধীরে ধীরে, গুটিসুটি পায়ে ‘প্রথম বিশ্বে’র দেশেও কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা যদি ঠেকাতে হয়, তাহলে সবার আগে প্রয়োজন এই গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে আসা লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান ওয়াল্ট দুই বছর আগে দশটি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। ট্রাম্প তখন মাত্র ক্ষমতায় এসেছেন, সে সময় ওয়াল্টের কথা কিছুটা উদারনৈতিকদের মনোভঙ্গের একটি প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল। এখন, প্রায় তিন বছর ট্রাম্পকে ক্ষমতায় দেখার পর সে ভবিষ্যদ্বাণী কঠোর বাস্তব বলেই মনে হচ্ছে।

যে দশটি লক্ষণ তিনি নির্দেশ করেন তা মোটামুটি এই রকম: ভীতি অথবা উৎকোচের মাধ্যমে তথ্যব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ; একটি তাঁবেদার তথ্যব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা (যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে ফক্স নিউজ, ভারতে রিপাবলিকান টিভি); সরকারি প্রশাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দলীয়করণ; বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারির জন্য সরকারি গোয়েন্দা ব্যবস্থার ব্যবহার; অনুগত ব্যবসায়ীদের পুরস্কার, অবাধ্য ব্যবসায়ীদের শাস্তি; বিচারব্যবস্থা নিজ মুঠোয় নিয়ে আসা; শুধু এক পক্ষের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা আইনের প্রয়োগ; নিজ স্বার্থে ভোট ব্যবস্থার অনিয়ম; ভীতি ছড়ানো (যেমন, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে অশ্বেতকায় বহিরাগত, মোদির ক্ষেত্রে মুসলিম); বিরোধী রাজনীতিকদের ব্যাপারে মিথ্যা প্রচার। ওয়াল্টের এই তালিকাকে ‘চেকলিস্ট’ হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকা অথবা অন্য কোনো দেশ কতটা কর্তৃত্ববাদী, তা মেপে দেখার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহেও সিএনএনের তথ্যমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান স্টেটলার এই ‘চেকলিস্টের’ প্রতিটি লক্ষণ দাগিয়ে দেখালেন কেন ও কীভাবে ট্রাম্প একজন প্রকৃত কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। আমার ধারণা, একই তালিকা ব্যবহার করে মোদিকেও অনায়াসে কর্তৃত্ববাদী প্রমাণ সম্ভব।

এই চেকলিস্টে যা অনুপস্থিত তা হলো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যমণ্ডিত কোনো দেশে কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দেয় কেন। আমরা তো এত দিন বলে এসেছি নিবিড় বা পোক্ত-গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে আইনের শাসন রয়েছে, শাসনতান্ত্রিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ রয়েছে, মুক্ত তথ্যব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কর্তৃত্ববাদ বা স্বৈরশাসন আসন গেড়ে বসতে পারে না। তাহলে?
পশ্চিমের বড় বড় থিংক ট্যাংক যেমন ফ্রিডম হাউস ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট—সবাই বলছে বিশ্বে গণতন্ত্র পিছু হটছে, কিন্তু কেন, তার কোনো সদুত্তর নেই। পাঠক সম্ভবত জেনে বিস্মিত হবেন, আমেরিকা এবং একাধিক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে ৩০-অনূর্ধ্ব ভোটারদের একটি বড় অংশ গণতন্ত্রের পরিবর্তে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক, পত্রপত্রিকায় যাদের ‘স্ট্রং ম্যান’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে থাকে। গত এক-দেড় দশকে আমরা যেসব ‘স্ট্রং ম্যান’–এর উত্থান দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবার রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে জনপ্রিয়তাবাদ বা ‘পপুলিজম’। একদিকে ভীতি, অন্যদিকে ঘৃণা এঁদের হাতে প্রধান অস্ত্র। অন্য ধর্মের মানুষ, অন্য বর্ণের মানুষ, অন্য ভাষাভাষী মানুষকে ‘বহিরাগত’ এবং ‘ভিন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক প্রবল জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার বিস্তার ঘটাতে এরা দক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যে বরিস জনসন অথবা ব্রাজিলে বলসেনারোর উত্থানের পেছনে রয়েছে এই ভীতি ও ঘৃণা। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের নরেন্দ্র মোদিকেও এই তালিকায় ফেলা যায়।

গণতন্ত্র যে এখন পিছু হটছে, সেটি গণতন্ত্রের অপরাধ নয়। বস্তুত, অন্য সবকিছুর মতো গণতন্ত্রের দৃঢ়তা নির্ভর করে আমরা সে গণতন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণে কতটা যত্নবান, তার ওপর। এই ‘আমরা’ বলতে বোঝাচ্ছি একদিকে রাজনৈতিক দল, অন্যদিকে নাগরিক সম্প্রদায়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ভোটে অংশগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে, এটি নাগরিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্থের ভূমিকা প্রবল হয়ে উঠেছে, যা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সাগ্রহ অংশগ্রহণে। একে আমরা রাজনৈতিক দুর্নীতি বলে চিহ্নিত করতে পারি। রাজনৈতিক নেতা ও দলের প্রতি অনাস্থা নবীন ভোটারদের মনে পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিই আস্থাহীন করে তুলেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন সম্ভব, এ কথায় তাঁদের বিশ্বাস হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থায় ট্রাম্প, দুতার্তে, মোদি বা বলসোনারোর মতো রাজনৈতিক ‘ডেমাগগ’দের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।

গণতন্ত্রের একটি প্রধান রক্ষাকবচ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্যব্যবস্থা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনার চাপে তথ্যব্যবস্থা দ্রুত তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলছে। রাজনীতিতে যেমন, তথ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অর্থ হয়ে পড়েছে মুখ্য। ফলে সত্য-মিথ্যা ধরিয়ে দেওয়ার মতো নিরপেক্ষ ‘রেফারি’ কার্যত উবে গেছে। কর্তৃত্ববাদী প্রচার-প্রচারণায় সত্যের পরিবর্তে ‘বিকল্প সত্য’ আবিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি প্রমাণনির্ভর সত্যের বদলে ‘বিশ্বাসনির্ভর’ সত্য আবিষ্কৃত হচ্ছে, তা দ্রুত নাগরিক মনে একমাত্র সত্য হিসেবে স্থানও করে নিচ্ছে। (ভারতে এখন ক্লাসে যে ইতিহাস পাঠ দেওয়া হচ্ছে তাতে জানানো হচ্ছে প্রাচীন ভারতে শুধু বিমান ও রকেট ছিল তা–ই নয়, সেখানে প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক সার্জারিও হতো। প্রমাণ গণেশের নাক!)।

তাহলে অবস্থা বদলাবে কীভাবে? উত্তরটা খুব সহজ নয়, নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন। কেউ বলছেন, আইন করে রাজনীতিতে অর্থের ভূমিকা হ্রাস করতে হবে। কেউ বলছেন, চলতি নির্বাচনী ব্যবস্থার বদলে আনুপাতিক নির্বাচন চালু করতে হবে। কেউ কেউ আবার বহুদলীয় ব্যবস্থার বদলে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু পণ্ডিতেরা চাইলেন আর ঠিক তেমন তেমন পরিবর্তন ঘটে গেল, তা তো নয়। গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা বেড়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেই। তাকে যদি বদলাতে হয় তাহলে সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেই পরিবর্তন আনতে হবে। আর তার চাবিকাঠি রয়েছে নাগরিকদের হাতে। শাসকের পরিবর্তন থেকে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, বিপ্লব থেকে রাজনৈতিক সংস্কার, সবই সম্ভব হয়েছে নাগরিক দাবি ও অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার পরিবর্তনও সম্ভব শুধু নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

সে সম্ভাবনার কিছু কিছু প্রমাণ মিলেছে আজকের ভারতে (দিল্লির সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপির গো-হারের কথা মনে করুন)। নভেম্বরে আমেরিকায় নির্বাচন। নাগরিক অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে এখানেও সেই পরিবর্তন অর্জন সম্ভব।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক