মুজিব বর্ষ: উপলক্ষটি হোক নেতাদের আত্মসমীক্ষার

কিছু কথা অতি সত্য হলেও কারও কারও কানে তা অতি কটু শোনায়। তা শুনলে তাদের কর্ণমূল রক্তিম হয়ে ওঠে। তাদের মনের কথা: পুরোনো কাসুন্দি না ঘাঁটা ভালো। তবে কাসুন্দি পুরোনো হোক বা সদ্য তৈরি হোক, তাতে ঘোঁটা দেওয়ার প্রয়োজন হয় কখনো কখনো। ঘোঁটা সবাই দিতে পারেন না। অনেকে চক্ষুলজ্জাবশত দেন না। তবে যেসব মানুষের চক্ষুলজ্জা নেই, তাদের কিছু সত্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার।

এ বছর জাতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করবে। এটি একটি বিরল উপলক্ষ। তাঁর জন্মশতবর্ষ পালন শুধু তাঁর দলের লোকদের বিষয় নয়। ইতিমধ্যে তাঁর দলীয় লোকদের অতি তৎপরতা লক্ষ করে জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে কাউকে অতি উৎসাহী হয়ে ম্যুরাল তৈরি না করার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘মুজিব বর্ষ নিয়ে কেউ অতি উৎসাহী হবেন না। এত উৎসাহী থাকলে’ ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর লাশ সেখানে পড়ে থাকত না। আমার মা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) এবং পরিবারের সদস্যদের রেড ক্রিসেন্টের শাড়ি দিয়ে দাফন করা লাগত না। এখন আমি মারা গেলে কী হবে, তা-ও জানি। কাজেই কোনো বাড়াবাড়ি নয়।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ]

১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় এ নির্দেশ দেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খবর পেয়েছি বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির অর্থ দিয়ে জাতির পিতার ম্যুরাল তৈরি করা হচ্ছে। এটা যেন করা না হয়। কেউ যেন অতি উৎসাহী হয়ে যত্রতত্র বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ না করেন।’

এ সময় একজন মন্ত্রী বলেন, ‘নেত্রী, আমরা চাই জাতির পিতাকে সবাই স্মরণ রাখুন। সে কারণে ব্যতিক্রমী কিছু একটা করতে চাই। আমরা সেভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা দেখেছি। আমার বাবার লাশ ৩২ নম্বর বাড়িতে পড়ে ছিল। মায়ের দাফন হয়েছে রেড ক্রিসেন্টের কাপড় দিয়ে। এত উৎসাহী কেউ তখন ছিল না।’

প্রধানমন্ত্রী তাঁর মায়ের একটি কথা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আব্বাকে আমার মা বলতেন, “আপনি যখন জেলে যান, তখন সাজানো বাগান রেখে যান। কিন্তু জেলখানায় যাওয়ার পরই এ বাড়ি (ধানমন্ডি ৩২) বিরানভূমি হয়ে যায়। কেউ আসে না, যদি আমাদের সহায়তা করতে হয়। আবার আপনি যখন আসেন, তখন বাগান ভর্তি হয়ে যায়। ” কাজেই আমার এবং রেহানার পরিষ্কার বার্তা—আমরা চাই না মুজিব বর্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ি কিছু হোক।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন]

মানুষের কোনো কোনো বুকের ক্ষত কোনো দিনই শুকায় না, তা থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ হতে থাকে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ক্ষত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আজীবন বহন করবেন। তবে জগৎসংসারে চলতে গেলে মনের কষ্ট গোপন রেখেই কাজ করতে হয়। চাটুকার সুবিধাভোগীদের কৃত্রিম বিরক্তিকর বঙ্গবন্ধুপ্রেম তাঁর সহকর্মী ও অনুসারীদের অকৃতজ্ঞতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজারা কষ্ট পান।

কৃতঘ্নতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সব দেশেই কমবেশি রয়েছে। কিন্তু ‘চামচামি’ ও ‘নিমকহারামি’ শব্দ দুটি একেবারে বাঙালির নিজস্ব। গত ১০০ বছরে বহু জননেতা ও রাষ্ট্রনায়ক আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন, কিন্তু’ ৭৫-এর ১৫ আগস্টের মতো নারকীয় ঘটনাটির তুলনা কোথাও নেই বললেই চলে। বর্বর পশুশক্তি যা খুশি তা-ই করতে পারে, কিন্তু মানুষ যদি তার কর্তব্য পালন না করে, তা নিন্দনীয় শুধু নয়, ঘৃণার্হ। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ও অনুসারীরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার কাফফারা বা পাপমোচন এখন আর কোনো কিছু করেই সম্ভব নয়।

‘গাদ্দার’ শব্দটি অবাঙালি পাকিস্তানিদের মুখে শুনেছি। গাদ্দারের তালিকায় মোশতাকের রোল নম্বর ১, কিন্তু পঁচাত্তরের নিমকহারামদের দীর্ঘ তালিকায় শুধু যে বঙ্গবন্ধুর দলের নেতাদের নাম রয়েছে, তা-ই নয়; বিভিন্ন পেশাজীবীর স্বনামধন্য ব্যক্তিদের নামও প্রচুর। তাঁরা কেউ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, কেউ সুবিধাধন্য। তাঁরা সেই বিরল ভাগ্যবান, যাঁরা পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকদেরও আনুকূল্যবঞ্চিত হননি।

অনেকে সাফাই হিসেবে বলবেন তাঁরা পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকারের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন, মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, কেউ দেশত্যাগী হয়ে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ করতে অস্ত্রও হাতে তুলে নিয়েছিলেন, হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি গায়ে শীতের রাতে মেঘালয় পাহাড়ের গাছের ডালে বসে রাত কাটিয়েছেন (তাঁদের স্মৃতিকথামূলক বই থেকেই জানা যায়), কিন্তু সে সবই করেছেন অনেক দেরিতে। ১৬ আগস্ট রাজপথে নামেননি জীবনের ভয়ে। নেতারা নামলে জনগণ নামত। সেই জনতাকে গুলি করে মারার ক্ষমতা ডালিম-ফারুকদের ছিল না। শুধু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নন, নতুন প্রজন্মের মানুষ এ প্রশ্ন করতে পারে।

শুধু প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চাঁদাবাজির নতুন ‘দোকান’ যেন খোলা না হয়। গ্রামগঞ্জের দোকানদার-ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সামনে মোটরসাইকেল খান কয়েক এসে দাঁড়ালে তাঁদের রক্ত হিম হয়ে যায়। একশ্রেণির বাঙালি জানে, কোন উপলক্ষ থেকে কী প্রাপ্তিযোগ ঘটা সম্ভব!

বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের উত্থান ঘটতে শুরু করে পঁচাত্তরের পরে। আজ লুই কানের নকশা করা আইয়ুবের নির্মিত শেরেবাংলা নগরের ভবনটি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের হেডকোয়ার্টার্সে পরিণত হয়েছে। অল্প কয়েকটি বনেদি ব্যবসায়ী পরিবার বাদে বাঙালি ব্যবসায়ীদের অকল্পনীয় উত্থান ঘটেছে সামরিক শাসকদের আনুকূল্যে। ব্যাংকের টাকা পাচার শুরু হয়েছে অসামরিক সরকারের সময়ে। নির্বাচন নামক ব্যাপারটিতে রাজনৈতিক নেতাদের কোনো দাম নেই। তাঁরা জানেন, বস্তা বস্তা টাকা না থাকলে তাঁরা নমিনেশন পাবেন না।

আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্যটির পালাক্রমে অস্থায়ী বাসিন্দা হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো সৌভাগ্যবান বাঙালির এমনই নিয়তি যে রাজনীতিকদের পাশে ঠেলে দিয়ে তাঁরাই আজ জাতির ভাগ্যবিধাতা। আশির দশকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছোট স্মরণসভার জন্য ১০০ টাকা চাঁদা চেয়ে যাঁর থেকে পাওয়া যায়নি, আজ তিনি অবলীলায় আওয়ামী লীগের সাংসদ।

রাজনৈতিক নেতাদেরও প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। তাঁরা যে শুধু প্রধান নেতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তা-ই নয়, জনগণের থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন। যাঁরা নেতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন, জনগণ তাঁদের বিশ্বাস করবে কেন? ফলে রাজনীতি তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন শুধু চাটুকারিতা ও চামচামি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।

যে পেশার মানুষই হোন, প্রত্যেকের কথাবার্তা হিসাব করে বলা ভালো। প্রতিদিন বলা হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ। একটি বালকও জানে তারা যে শুধু ব্যর্থ তা নয়, ব্যর্থতম।’ ৭৫-এর পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের কী সাফল্য ছিল? ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা যেমন-তেমন ব্যর্থতা নয়। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে ১৩ বছর। ১৯৮১-তে পরিবার-পরিজন ও প্রিয়জনহীন দেশে অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনা দেশে না এলে, শুধু ২১ বছর নয়, সমস্ত একুশ শতকেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত, সে ভরসা ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মসমীক্ষা ও আত্মসমালোচনারও একটি উপলক্ষ বটে। তার পরিবর্তে যদি তাঁরা বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে আত্মরক্ষার পথ বেছে নেন, তাতে দলের কোনো উপকার হবে না। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন পাকিস্তান সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একদল বাঙালির হাতেই সপরিবার নিহত হন। এবার তাঁর জন্মশতবর্ষে সুবিধাভোগী দলীয় নেতাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা তাঁর আত্মাকে কষ্ট দেয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক