দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট খেলোয়াড়েরা

পাপিয়া আবিষ্কার কাহিনিতে একটি সংলাপ থাকা দরকার ছিল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন, বস?’ চলমান রাজনীতি ও অর্থনীতির মিলনে যাদের সৃষ্টি, তাদের কেউ ক্যাসিনো সম্রাট আর কেউবা হোটেল সম্রাজ্ঞী পাপিয়া। খলসময়ের খলকাহিনি খল পার্শ্বনায়ক-পার্শ্বনায়িকা। মূল নায়ক-নায়িকা হতে এঁদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হতো। এঁদের অভিযাত্রা রোমাঞ্চকর, শ্বাসরুদ্ধকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। একজন প্রতিষ্ঠিত মাফিয়ার নেতা, এমপি, শিল্পপতি, বিজনেস ম্যাগনেটে পরিণত হওয়ার শেষ ধাপটা খুব বিপজ্জনক। তার আগেই অনেকে ঝরে যায়। ক্যাসিনো সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ বা পাপিয়ারা শেষ ধাপে আটকে গেলেন। এই পতন মাফিয়া মহলের ভেতরে চলতে থাকা তুমুল প্রতিযোগিতার ফল। 

একেকজন মাফিয়া ‘বস’কে ফুলে ফলে ফুটিয়ে তুলতে মোটামুটি পাঁচ বছর লাগে। এই কাহিনির প্রথম অধ্যায়ের সাক্ষী জেলা শহর। সেখানকার উঠতি যুব নেতা–নেত্রীরা প্রথমে দলের ছোট নেতা হয়ে ক্ষমতার নেটওয়ার্কে জড়ান। এই পদ দখলের প্রতিযোগী অনেক। ওপরের মহলের চাহিদা মেটানোর কলাকৌশল যার হাতে বেশি, তিন তত আগুয়ান। তারপর শুরু হয় পদ ধরে রাখার যুদ্ধ, টাকা বানানোর সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। চালিয়ে যেতে পারলে এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। একবার হয়ে গেলে আর ছোঁয় কে। ব্যর্থ হলে বিদেশে পালানোর চেষ্টা হয়। জায়গা নেন ‘বেগমপাড়ায়’। একবার বিদেশে পগারপার হতে পারলে চুপচাপ সঞ্চিত সম্পদ ভোগ করা আর দেশে ফেরার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার গুণ এদের আছে। আজকের অনেক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত নেতার অতীত এমনই। এই খেলাই চলছে হরদম হরদম। 

এরা কলঙ্ক নয়, এরাই অলংকার এই রাজনৈতিক অর্থনীতির। একজন পড়ে তো আরেকজন ওঠে। জোগান চলতেই থাকে। নিচ থেকে ওপরে সম্পদ ও সুযোগ দখলের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এদের দরকার দুই কারণে। এঁরা কেন্দ্রে থাকা প্রতাপশালী ব্যক্তিদের নোংরা কাজগুলো করে দেন। তাঁদের অর্থ ও ক্ষমতার কারবারের যে রশি টানা আছে, এঁরা তার একেকটি গিঁট। আবার ওপর থেকে নিচের মহলে ক্ষমতা ও ইনাম বণ্টনের মাধ্যমও এরাই। 

নিয়মিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন যে দেশে পাকাপোক্ত সেই দেশে মাফিয়াচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতি মূল খাত হয় না। বাংলাদেশে হয়, কারণ তেমন ‘ভালো’ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সুন্দর পরিবেশ এই দেশে আছে। ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতি এই ধরনের ‘লিজেন্ড’ ‘গডফাদার’ ‘আম্মাজান’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের উর্বর অভয়াশ্রম। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা মহানগরগুলোতে এরা গড়ে তোলে শাদ্দাদের স্বর্গ, আলিশান প্রাসাদ। মজা ও মানিকে (অর্থ) একাকার করে ফেলার ওস্তাদি এখানেই জমে। গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার আলো-আঁধারিতে এদের বিচরণ। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের মতে, কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ৪২-৮০ শতাংশের মধ্যে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা; যা তিনটি বাজেটের সমান। আর পুঞ্জীভূত কালোটাকার পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ লাখ কোটি টাকা; যা বর্তমানের দুটি জিডিপির সমান। আদর করে একে ইনফর্মাল ইকোনমি ডাকা হলেও আসলে তা ডাকাতির কারবার। সাম্প্রতিক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচার কিংবা রানা প্লাজা ও হল–মার্ক কেলেঙ্কারিকেও এরা ছাপিয়ে যাচ্ছে। 

সমাজে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা যত বেশি ততই এদের মওকা বাড়ে। এদের ক্যারিয়ারে টাকার খেলাকে সঙ্গ দেয় নারী, মদ আর ফুর্তি। সাধারণত এদের পারিবারিক জীবন হিন্দি সিরিয়ালের মতো কুটিল এবং যৌনজীবন হয় বিকৃত। ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাবনা বজায় রাখতে গ্রামেও এদের খুঁটি পোঁতা থাকে। দুর্বৃত্ত নেটওয়ার্ক তথা ‘ব্যবসায়িক সম্পর্ক’ তখন তাদের জয়ী করে। এসব চালাতে হলে তাদের থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের লাঠিয়াল এরা। 

এরা গতিশীল, খোলস বদলাতে ওস্তাদ। নেতা থেকে ব্যবসায়ী, মাফিয়া থেকে এমপি, ব্যবসায়ী থেকে লাভজনক সংস্থার পদাধিকারী হওয়ার দৌড়ই এদের আত্মজীবনী। বিশ্বায়নের সুবাদে বিদেশে অবধি এদের দৌরাত্ম্য, অনেক সময় সেটাই ‘সেকেন্ড অপশন’। রাজনীতি ও অর্থনীতির নিত্যনতুন সুযোগ হাসিল করায় চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে হয়। সেখানে গড়বড় হলেই পতন। 

এটা এমন এক সময়, যখন এক প্রজন্মেই কেউ ধনকুবের হয়ে যেতে পারে অথবা এক প্রজন্মেই বাদশাহ হয়ে যান ফকির। অনেক সময় গোনা সম্ভব হয় না বলে এরা টাকা বা স্বর্ণ ওজন দিয়ে পরিমাপ করে। অস্থিতিশীলতার ভয়ে রূপকথার গল্পের কায়দায় বালিশের মধ্যে কিংবা গর্ত খুঁড়ে টাকা রাখে। রাতারাতি এরা বিদেশে বড় শহরে বিরাট বিরাট ভবন বা প্রাসাদ কিনে ফেলে, করমুক্ত টাকা রাখার জায়গা না পেয়ে অবিশ্বাস্য মূল্যের ঘড়ি, আংটি বা গাড়ি কেনে। আখেরে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলার জাদু এরা জানে। এরা উদার, নরম মেরুদণ্ডের আদর্শহীন অভিযাত্রী। এরা দেখনেওয়ালা নয়, এরা করনেওয়ালা। তাই জনতা ও ক্ষমতার কাছে এরা দরকারি। টাকা বানাবার শিল্পকে এরা বসগিরির শিল্পে পরিণত করে। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো পাপিয়ার হাতের লাঠি সেই বসিংয়ের একটা প্রতীক। ভারতের ‘লেডি দাবাং’ পার্তিয়ালা রবির সঙ্গে তুলনা চলে তাঁর। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন সত্যি সত্যি হচ্ছিল। একজন মানুষ এখানে পিঁপড়ার মতো ৮-১০ জনকে বহন করে যান, চাকরি বা কাজের জোগান দেন অনেকের। একজন প্রবাসী শ্রমিক, কিংবা একজন ছোট খামারি বা ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক এবং সমাজসংস্কারক ও প্রতিবাদীরা ছিলেন এই গল্পের নায়ক-নায়িকা। পরিশ্রম ও বুদ্ধি করে এক প্রজন্মে অবস্থা ফেরানোর আত্মবিশ্বাস অনেককেই উচ্চাভিলাষী করে তুলেছিল। তার সুফল দেশ পেয়েছে। তাদের হটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী পাপিয়ারা। এরা একজনে লক্ষজনের সুযোগ ও সম্পদ আত্মসাৎ করে উন্নয়নের চাকাটাকে সত্যিই ভেঙে ফেলছে। ক্ষমতা ও বিত্ত হাতানোর এই ‘গোল্ড রাশ’ কতটা ভয়াবহ, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ও রাজনৈতিক চালচিত্র তা হাড়ে–মাংসে বুঝিয়ে দিচ্ছে। 

এরা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, এরা দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট নায়ক-নায়িকা। জনগণ এখানে পার্শ্বচরিত্রও নয়, ভুক্তভোগী দর্শকমাত্র। 

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক