শিশু নিতি, জীবিত বা মৃত - লাঞ্ছিত

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ নাকি আত্মহত্যায় পৃথিবীতে দশম স্থানের অধিকারী। এই হিসাবের মধ্যে হত্যা করে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কেসগুলো আছে কি না, কে জানে? তবে আত্মহত্যা বা কথিত অপমৃত্যু যে দিন দিন বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাস দুয়েক আগে (ডিসেম্বর ৭, ২০১৯,) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘দেশে প্রতিদিন ২৮-৪০ জন আত্মহত্যা করে।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের মতে, বড়দের সঙ্গে শিশু ও কিশোরেরাও আত্মহত্যা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণে শিশুর আত্মহত্যার হার অনেক বেড়ে গেছে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যা, এতিমখানার নিষ্ঠুরতা সইতে না পেরে আত্মহত্যা ছাড়াও অবহেলা–অপমান, সামাজিক নিগ্রহ প্রভৃতি কারণে অতিষ্ঠ হয়ে শিশুদের আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রে অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে।

নালিতাবাড়ীর বছর দশকের বালিকা নিতির হঠাৎ চলে যাওয়াটা আত্মহত্যা, নাকি হত্যা, তা নিশ্চিত হতে আরও তদন্তের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের কাজ তারা করুক, তাতে কারও তাড়া নেই। নিতি যে নেই, সেটাই এখন সত্য। নিতির আকস্মিক চলে যাওয়াটা হৃদয়বিদারক হলেও তার ওপর কোনো নির্মমতার ছাপ অনেকের চোখেই পড়েনি। যে নির্দয়তার মধ্যে নিতি বেঁচে ছিল বা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল, সেটা কি কারও আঁচ–অনুমানের মধ্যে ছিল? যে স্কুলে মেয়েটি পড়ত, সেই স্কুলের শিক্ষক–শিক্ষিকারা জানতেন কি তার মনের খবর? এটা কি তাঁদের কর্মতালিকার মধ্যে পড়ে আসলে?

নিতির করুণ পরিণতির কথা যেদিন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয় (২৬ ফেব্রুয়ারি), তার দিন সাতেক আগে (১৮ ফেব্রুয়ারি) পৃথিবীর অন্য গোলার্ধ থেকে (অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন) অন্য অর্থনীতির এক মা (ইয়ারা বেইলিস) এক মর্মস্পর্শী আবেদন সারা দুনিয়ায় সংক্রমিত হয় আলোর বেগে। নিতির চেয়েও ছোট তাঁর ৯ বছরের শিশু সেখানকার সমাজের আর সহপাঠীদের হাসি-হাট্টা অবহেলায় আর যেন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশু কুয়াদেন আর বেঁচে থাকতে চায় না। মায়ের কাছে শিশুটির এখন একমাত্র আবদার, ‘মা, তুমি আমাকে একটা দড়ি এনে দাও। আমি গলায় ফাঁস দিয়ে মরব।’ ছেলের এই কষ্টের কথা ক্যামেরাবন্দী করে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছিলেন অসহায় মা। চেয়েছিলেন সবার সহযোগিতা। কুয়াদেনের মা চান, বিদ্রূপের শিকার হয়ে আর কোনো শিশু যেন জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে। ভিডিওতে কুয়াদেনকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি শুধু আমার বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চাই। আমি চাই, আমাকে কেউ মেরে ফেলুক।’

শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হলে কুয়াদেনের মতো অসহায় শিশুদের জীবনে তা যে কত বড় প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে মূলত সবাইকে সচেতন করতেই আদিবাসী অধিকারকর্মী এই মা ইয়ারা বেইলিস এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কুয়াদেনের মা চান, বিদ্রূপের শিকার হয়ে আর কোনো শিশু যেন জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে। মা ইয়ারা বেইলিস তাঁর বক্তব্যে এটাও বলেছেন, ‘আমি সাধারণত বিষয়টি চেপে থাকি। কারণ, এটি ব্যক্তিগত বিষয়। তবে আর চেপে রাখতে পারলাম না। আমি এইমাত্র ছেলেটিকে স্কুল থেকে নিয়ে এলাম এবং দেখলাম, তাকে কীভাবে অপমান করা হচ্ছে। আমি বিষয়টি প্রিন্সিপালকে জানিয়েছি। সমাজের লোকদের জানাতে চাই, এ রকম সামাজিক পীড়ন আসলে জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে। আমার ছেলেকে তো দেখছেনই।

শারীরিক ত্রুটির কারণে আমাদের সমাজে বিদ্রূপ, হাসি–ঠাট্টা, সামাজিক পীড়ন খুবই সাধারণ ব্যাপার। এটাকে অনেকেই বিনোদনের একটা উপাদন হিসেবে ব্যবহার করেন, উতসাহিত করেন অন্যদেরও। কিন্তু সামাজিক ত্রুটির শিকার শিশুদেরও কি কম ঝক্কি পোহাতে হয়? প্রান্তিক শিশুদের জন্য চালু স্কুল দেখতে গিয়ে কখনো কখনো নজরে এসেছে যে স্কুল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কি নিদারুণ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে শিশুদের প্রান্তিকতা আর তাঁদের (প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত) অর্জন হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন।

‘এই যে দেখুন এই মেয়েটির মা–বাবা কেউ তাকে নেয়নি। দাদির কাছে থাকে, দাদি ভিক্ষা করে চলেন। মা আবার বিয়ে বসেছেন, বাপে খোঁজখবর রাখেন না। আগেই ভেগেছে সে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো কোনো পরিদর্শক আবার আরও গভীরে যেতে চান, শিশুর বয়ান থেকে জানতে চান আরও অনেক সামাজিক নির্মমতার কথা। এগুলো একধরনের সামাজিক নিগ্রহ। ভেঙে যাওয়া বিভক্ত পরিবারের শিশুদের নিত্যদিন এমন সামাজিক নিপীড়নের গরম তাওয়ার ওপর দিয়ে পা পুড়িয়ে, মন পুড়িয়ে সহ্য করে টেনে টেনে এগিয়ে যেতে হয়। নিতি হয়তো আর নিতে পারেনি নিত্যদিনের সামাজিক নীপিড়নের ভার; তাই সে থেমে যাওয়ার কথা ভেবেছে, আত্মহত্যার আগে চিরকুট লিখে বলে গেছে তার বেদনার কথা।

শিশুর প্রতি আমাদের সামাজিক অবহেলা ও নির্মমতার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যখন পুলিশি আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যায় নিতির মরদেহ গ্রামে নিয়ে আসা হয়। তাকে কেউ গ্রামে দাফন করতে দেয়নি। গ্রামের বারোয়ারি কবরস্থানে তো নয়ই, এমনকি দাদির বাড়িতে কবর দিতে চাইলেও প্রতিবেশীরা বাধা দেয়

দশ–এগারো বছরের ছোট্ট নিতি কোনো খুনি–ডাকাত, ধর্ষক–রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী কিংবা মানবতাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল না। ক্যাসিনো বা কোনো এসকোর্ট সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিল না তার নাম। এরপরও তার বাপ–দাদার গ্রামে তাঁর লাশ দাফন করা গেল না। প্রতিবেশী ও সমাজপতিদের বাধার মুখে অসহায় দাদি দূরগ্রামে বিয়ে হওয়া তাঁর এক মেয়ের কাছে আকুতি জানান। শেষ পর্যন্ত সেই দূর গ্রামে নিতির ফুফুর বাড়িতে জানাজা শেষে দাফন করা হয় নিতিকে। এ বিষয়ে নিতির দাদি লাল বানু সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এ রকম একটা শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তাঁরা সান্ত্বনা তো পাননি বরং শোকের মধ্যেও নিতির জন্য গ্রামের লোকজনের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। তবুও বাড়িতে কিংবা বাড়ির পাশে কবরস্থানে দাফন করতে পারেননি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের যে সদস্য (ফিরোজা বেগম) নিতিদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে গ্রামে দাফনে বিরুদ্ধে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, ‘ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার মৃত্যুতে লোকজন ভয় পায়, তাই সামাজিক কবরস্থানে দাফনে এলাকাবাসী বাধা দেন। যার কারণে শিশুটিকে সেখানে দাফন করা যায়নি।’ বলা বাহুল্য, এই সবই অজুহাত—নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি। হয়তো অসহায় দাদির শেষ সম্বল ভিটেটার ওপর কারও নজর আছে, সেখানে একটা কবর হলে ‘জায়গা’ নষ্ট হয়। তাই ভূতের কাহিনির ওজর। আর যে যুক্তি দিয়ে ভিটেতে দাফন বন্ধ করা, সেই ভূতের ভয় তো গ্রামের সাধারণ কবরস্থানের বেলাতেও প্রযোজ্য। তাই আন্ধারুপাড়াকে আন্ধারে রেখে দিলেন সমাজপতিরা। অবশ্য নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বশির আহমেদ বলেছেন, বিষয়টি পুলিশকে জানায়নি কেউ। জানালে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হতো। একটি শিশুর বেলায় কেন এ রকম করা হলো তা জানতে খোঁজ নেবে পুলিশ। সেটাই এখন একমাত্র ভরসা।

লেখক: গবেষক