কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক

অপরাধপ্রবণ লোকেরা শুধু সেই সব মানুষেরই ক্ষতি করে না, যাদের ওপর তারা অপরাধ ঘটায়। তারা পুরো সমাজেরও ক্ষতিসাধন করে; তাদের কারণে পাড়া-মহল্লাগুলোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়, শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার অবনতি ঘটে। তাদের মধ্যে যারা শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতার পৃষ্ঠপোষকতা করে, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটা অংশকে বিপথগামী করে, তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে সহিংস কিশোরদের যেসব গ্রুপ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, খুনোখুনিও বাদ দেয় না, তারা প্রাপ্তবয়স্ক কিছু মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা, এমনকি প্রণোদনাও পেয়ে থাকে। সহিংস কিশোরদের গ্রুপগুলো ঠিক প্রাপ্তবয়স্ক সংঘবদ্ধ অপরাধী দলের মতো নাম পেয়েছে ‘গ্যাং’। বাংলাদেশে এই সব ‘কিশোর গ্যাং’ মাঝেমধ্যেই চাঞ্চল্যকর সংবাদ শিরোনাম হয়। কিন্তু তাদের পেছনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকেরা প্রায়ই আড়ালেই থেকে যায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে পরিবেশিত খবরে তেমনই কয়েকজন মানুষের কথা জানা গেল। কারণ, চট্টগ্রাম মহানগরের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন পরিচালনার জন্য তাঁরা ওই মহানগরের বাসিন্দাদের ম্যান্ডেট পেতে চান। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন এমন সাতজন ব্যক্তি, যাঁরা কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে পরিচিত অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। তাঁদের মধ্যে দুজন আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে খোদ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পেয়েছেন। বাকি পাঁচজনের ভাগ্যে তা জোটেনি বলে তাঁদের বলা হচ্ছে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’।

এ থেকে মনে হতে পারে, চট্টগ্রাম মহানগরে তৎপর কিশোর গ্যাংগুলোর পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা এক ডজনও নয়। না, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি। খোদ চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের হিসাবের খাতাতেই নাম আছে ৪৮ জনের। যে সাত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের নামও পুলিশের সেই তালিকায় আছে। সেই সাতজনের মধ্যে আবার দুজন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ক্লিন ইমেজের লোকজনকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’ অর্থাৎ কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পুলিশের তালিকাভুক্ত দুই ব্যক্তি, যাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের তিনি ‘ক্লিন ইমেজের লোক’ বলে মনে করেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থনপ্রাপ্ত প্রার্থী (ওয়ার্ড নম্বর ১৩) ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর এলাকায় কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে খুনোখুনিতে গত বছরের ২৬ আগস্ট দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী এক কিশোর মারা যায়। আর ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সমর্থনপ্রাপ্ত প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত কলেজছাত্রী দিদার হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।

কাউন্সিলর পদপ্রার্থী অন্য পাঁচ ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সমর্থন না দিলেও তাঁরা প্রত্যেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত। তাঁদের মধ্যে একজন গুরুতর সন্ত্রাসী, পাঁচটি মামলার আসামি এবং র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারারুদ্ধ।

রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কোনো ব্যক্তির জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা নেই।ভোটাররা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতায় এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।