কত দূর যেতে পারে করোনাভাইরাস

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

প্রথমেই কিছু আশার কথা। করোনাভাইরাস নিয়ে অধিকাংশ গুজবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এটা জীবাণু অস্ত্র নয় বা চীনও হাজার হাজার মানুষের লাশ গোপনে পুড়িয়ে ফেলছে না। এর মধ্যে নতুন কথা ভাইরাল হলো, এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির সঙ্গে নাকি করোনাভাইরাসের ঘটনা মিলে গেছে। আমেরিকার বেস্ট সেলার থ্রিলার লেখক ডিন কুন্স ১৯৮১ সালে একটি বই লেখেন। বইয়ের নাম ‘দ্য আইস অব ডার্কনেস’। তাঁর ভক্তরা বলছেন, তিনি এই করোনাভাইরাসের বিষয়টা সেই ৩৯ বছর আগেই হুবহু বইতে লিখেছেন। তাঁর বইয়ে একটি জীবাণু-অস্ত্রের কথা লেখা আছে, ‘উহান-৪০০’। চীনের উহান শহরের গবেষণাগারে এটা চীনারা তৈরি করেছে বলে তিনি লিখেছেন। তা নিয়ে আবার অনেক জল্পনাকল্পনা।

রয়টার, নিউইয়র্ক টাইমস এবং অন্যান্য সংস্থা বিষয়টির সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তাতে বের হয়, ডিন কুন্সের বইয়ের সঙ্গে কিছু মিললেও বেশির ভাগ করোনাভাইরাসের সঙ্গে মেলে না। তিনি উহান শহরের কথা বলেছেন, ২০২০ সালের কথা বলছেন, সেগুলো মিলেছে। তবে তিনি বলছেন, এই ভাইরাস অন্য প্রাণীর শরীরে বাঁচতে পারে না, সেটা ভুল। করোনাভাইরাস ল্যাবরেটরি থেকেও বের হয়নি। তারপর তাঁর ভাইরাস-অস্ত্র উহান-৪০০, যেটাকে তিনি ১৯৮১ সালে প্রথম সংস্করণে লিখেছিলেন গোর্কি-৪০০, শতভাগ মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। করোনাভাইরাসের বেলায় তা ঠিক নয়, করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ। কাজেই মিলটা বেশ অদ্ভুত হলেও অমিলটাও অনেক বেশি। পরিশেষে রয়টার সিদ্ধান্ত দিয়েছে, ডিন কুন্সের ভক্তদের এই দাবি আংশিক ভুল। ভক্তরা অবশ্য ভুলটা দেখতে পান না, সামান্য শুদ্ধের অংশটুকু নিয়েই মাতোয়ারা থাকে। লেখক কুন্স নিজে এ নিয়ে কিছুই দাবি করেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য সব মহামারির মতোই, করোনাভাইরাসের মহামারি এবং আতঙ্ক একদিন অবশ্যম্ভাবীভাবে শেষ হবে। এর আগে সার্স (SARS), তারপর সোয়াইন ফ্লু (H1N1) মহামারিও অবদমিত হয়েছে। আরও আগে, অনেক ভয়াবহ মহামারি ছিল ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু। স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ মারা যায়। সেনাশিবিরে এই ভাইরাস ছড়ায় বেশি। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে যখন এক জায়গায় গাদাগাদি করে সৈনিকদের থাকার প্রয়োজন পড়ল না, তখন সেই স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণও আপনা-আপনি কমে গেল।

করোনাভাইরাস যে রোগটি ঘটাচ্ছে, তার নাম কোভিড-১৯। এটা আসলে একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু। একই লক্ষণ। সাধারণ ফ্লুর সঙ্গে এর অনেক মিল এবং বেশ কিছু তফাতও রয়েছে। এটা সহজে একজনের থেকে আরেকজনের কাছে চলে যাচ্ছে, ওষুধ নেই। কীভাবে এই মহামারি শেষ হবে? বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সম্ভাবনার কথা বলছেন। অথবা বলা যায় সব সম্ভাবনাই বিবেচনা করছেন।

১. গ্রীষ্ম চলে আসায় করোনাভাইরাস তাপমাত্রার কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সেটা হতে পারে। তবে এই ভাইরাস নতুন, এর গতি-প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি জানতে পারেননি। যদি গ্রীষ্মে সেটা নিজেই সরে যায়, তবে আবার হেমন্তে অথবা শীতে সে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

২. সব সংক্রমিত মানুষকে আলাদা করে রাখা (কোয়ারেন্টাইন) যেন আর সংক্রমণ না হতে পারে।
সেটা খুবই কঠিন। প্রায় অসম্ভব, কারণ সব আক্রান্ত মানুষকে খুঁজে খুঁজে আলাদা করা সম্ভব নয়।

৩. কোনো প্রতিষেধক বের করে সব সুস্থ মানুষকে সেই টিকা দেওয়া।
প্রতিষেধক নিয়ে খুব বেশি আশা বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না। একটি প্রতিষেধক পরীক্ষাগার থেকে শুরু করে বাজারে আনতে দশ বছরও লেগে যেতে পারে। প্রথমে আবিষ্কার করতে হবে, তারপর ইঁদুর–গিনিপিগের ওপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা চালানো, সেখানে সফল হলে কিছু স্বেচ্ছাসেবী মানুষের ওপর প্রয়োগ করে ফলাফল খুঁটিয়ে দেখা। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, সেটা বের করা, এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অসুখ হয়তো তেমন বড় ক্ষতিই করত না, কিন্তু ভুল হলে ওষুধই মানুষ মেরে ফেলবে। তবে তাঁরা বলছেন, এক বছরের মধ্যে কিছু একটা বের করা যাবে। কয়েক মাস হয়েই গেছে, আর হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিষেধক টিকা আসছে।

৪. সবার হয়ে গেলে আর নতুন কোনো সম্ভাব্য মানুষ থাকবে না, যার কাছে ভাইরাসটা গিয়ে সুবিধা করতে পারবে। কারণ, ভাইরাস একবার আক্রমণ করলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, পরেরবার আর অসুখটা হবে না। এমনটা যে হবেই, তা–ও বিশেষজ্ঞরা হলফ করে বলতে পারছেন না। নতুন ভাইরাস, অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে।

বোঝাই যাচ্ছে, ওপরের কোনোটাই এককভাবে হবে না। সব কটি একযোগে হয়তো এই সংকট থেকে উদ্ধারের কাজে লাগবে। এখন সংকটটা কী বা কত বড়, সেটা দেখা যাক।

আবারও প্রথমেই আশার কথা, করোনাভাইরাস মানেই যমদূত নয়। এটা হলে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো জ্বর-সর্দি-কাশি হবে। কারও একটু বেশি, কারও কম। বলা হচ্ছে, ৮০ ভাগ মানুষই অল্প কষ্টে সুস্থ হয়ে উঠছেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থ মানুষের ক্ষতি করে বেশি, এটাও তা–ই। তবে তফাত হলো, ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ আছে, এটার ওষুধ এখনো নেই। ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যাওয়ার হার শূন্য দশমিক ১ ভাগ (১০০০ জনে ১ জন), করোনাভাইরাসে মারা যাওয়ার হার প্রথমে শতকরা ২ ভাগ গণনা করা হয়, এখন সেটা নেমে এসে হয়েছে শতকরা ১ ভাগের মতো। এই হার ইনফ্লুয়েঞ্জার থেকে বেশি হলেও এটা যে অমোঘ মৃত্যুপরোয়ানা নয়, সেটাও বোঝা যাচ্ছে।

তাহলে এত হইচই কেন? এত সাজ সাজ রব কেন? তার একটা কারণ হচ্ছে, এই ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছু এখনো অজানা। লক্ষণ শুরুর আগেই আক্রান্ত মানুষটি ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটা সাধারণ ফ্লুর বেলায় ঘটে না। করোনাভাইরাস অন্য মানুষের কাছে যাচ্ছে মুখ থেকে বের হওয়া হাঁচি-কাশির সঙ্গে। পরিসংখ্যানমতে, একজন আক্রান্ত মানুষ গড়ে ২ দশমিক ২ জনের কাছে ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। এটা অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই একে বিশ্বজুড়ে মহামারি (প্যান্ডেমিক) বলে ঘোষণা দিতে হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই ঘোষণা দেবে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি মানেই রোগটা যে অনেক গুরুতর হতে হবে তা নয়; সামান্য সর্দি-জ্বর যদি বিশ্বজুড়ে মানুষের হয়, সেটাও মহামারি। এই ভাইরাসটা প্যান্ডেমিক হয়ে গেলেও মানুষ মেরে সাফ করে দেবে না বলে আশা করা যায়।

তাহলে ভয়টা কিসের? ভয় হলো, এটাকে এখনই কার্যকরভাবে থামানো না গেলে সে যদি নিজেই বসন্তে বা গ্রীষ্মে থেমে না যায়, তাহলে বিপদ হবে। এটা বারবার আসবে। যার একবার হয়েছে, তার অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হওয়ার কারণে আরেকবার হবে না, সেটাও বলা যাচ্ছে না। এটা মিউটেট অর্থাৎ অভিযোজনের মাধ্যমে আরও ভয়ংকর হতে পারে। সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ, এটার সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো বিজ্ঞানীদের অজানা রয়ে গেছে। তবে যতটুকু জানা গেছে, করোনাভাইরাস যদি তার বেশি ভয়ংকর না-ও হয়, তবু মহামারি হলে বিশ্ব অর্থনীতির এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করবে।

করোনাভাইরাস ঠেকানোর জন্য অনেক দেশ ইতিমধ্যেই সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। যাতায়াত–বাণিজ্য, এসবে সাংঘাতিক বাধা পড়ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ব্যাপারটা আরও বাড়লে মানুষের জমায়েত হতে পারে, এমন সবকিছুই স্থগিত রাখা হবে। প্রতিটা দেশকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে, তাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ২০২০ সালে পৃথিবীর জিডিপি যতটুকু বাড়ার কথা ছিল, করোনাভাইরাসের জন্য সেটা কমে অর্ধেক হবে। বিশ্বজুড়ে এটা বড় এক অর্থনৈতিক ধাক্কা।

ব্যাপকসংখ্যক মানুষ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন ঘটবে। বাসচালকের তিন দিন থেকে জ্বর, যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কাজ করে, তারও সর্দি–কাশি, কাজে যেতে পারছে না। যে দোকান থেকে আপনি সচরাচর সদাই করেন, সে দোকানটিও খোলেনি। দেশে দেশে সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করতে বাধ্য হবে। তাতে জীবনযাত্রা সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। তারপর আছে আতঙ্ক ও গুজব।

তবে করোনাভাইরাসের বিপদটা সত্যি। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সঠিক প্রস্তুতি নেওয়াটাই জরুরি।

মোস্তফা তানিম: বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক।