শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠনের সাহস কি আছে

দেশের ব্যাংক খাতের দুরবস্থার কারণে একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল দু-তিন বছর আগে। এর মধ্যে একটা জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছে। বদল হয়েছে অর্থমন্ত্রী। সুতরাং তিনিও শুনে আসছিলেন দাবির বিষয়টি। সংগত কারণেই হয়তো নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সেই শোনা কথার বিষয়টিই উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

সেই বাজেট বক্তৃতার পরে আট মাসের বেশি সময় চলে গেছে। তারপর থেকে আমরা সবাই শুনে আসছি যে ব্যাংক কমিশন হবে। এ নিয়ে আর কোনো আলোচনার কথাও দীর্ঘদিন শোনা যায়নি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কারণে এই ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা আবার নতুন করে শোনা গেল। অর্থমন্ত্রী বললেন, ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। এরপর সাংবাদিকসুলভ কাজের অংশ হিসেবেই আরও খোঁজখবর নিতে হলো। জানা গেল, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে এ নিয়ে সরকারের কিছু আলোচনাও হয়েছে। নিঃসন্দেহে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর।

ব্যাংক কমিশনের এসব খবর প্রথম আলোতে প্রকাশিত হলে দেশের একজন অর্থনীতিবিদ আমাকে ফোন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতের যে পরিস্থিতি, অর্থমন্ত্রীর যে অবস্থান, তার সঙ্গে ব্যাংক কমিশনের প্রধান হিসেবে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নামটি কি যায়? এর উত্তরে সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার, অর্থনীতিকে ঠিক পথে আনা, সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠাকে আমলে আনা—এ রকম অনেক ভালো কথা বলা হয়তো যেত; বরং সব ছাপিয়ে সংশয়টা নিজের মধ্যেও ঢুকে গেল। আসলেই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটা ভালো ও শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠন করার সাহস সরকারের আছে কি না।

এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। এ সময় অর্থনীতির সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও অনেক সামাজিক সূচকের অগ্রগতিতে; কিন্তু এ সময়ে পুরো আর্থিক খাতের চিত্রটি ছিল উল্টো। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ, বেসিক ব্যাংকের পতন, বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ চুরি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি, পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত, ব্যাংকমালিকদের বারবার সুবিধা দেওয়া, বড় বড় ঋণখেলাপিকে একাধিকবার বিশেষ ছাড়, খেলাপি ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে তালিকা যথেষ্ট লম্বা। সর্বশেষ ঘটনা হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) নামের একটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাহিনি। আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি অল্পদিনেই বুঝতে পারেন যে প্রতিষ্ঠানটি আসলে আর বাঁচানোর মতো অবস্থায় নেই, সুতরাং সরে যাওয়াটাই ভালো। তাই তিনি পদত্যাগ করেছেন। দেশের আর্থিক খাতের চিত্র এখন এই। আর এসব ঘটনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা কিন্তু মোটেই কঠিন নয়।

একসময়ের ভালো ব্যাংক বেসিক ব্যাংক পতনের মূল ব্যক্তি এর সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। নিয়োগ থেকে শুরু করে তাঁকে রক্ষা করার পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে সরকারই। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপ—এসব বড় ঋণ কেলেঙ্কারির স্থান হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ—সবকিছুই করেছে সরকার। নতুন ব্যাংক দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে—এই বক্তব্য ছিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। নতুন ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির দায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারেরই গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ছিলেন। বেনামে কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংক দখলের সহায়তাকারী সরকারেরই এক সংস্থা। আর এই পথ অবলম্বন করে প্রশান্ত কুমার হালদার একে একে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েও গেছেন। খোদ অ্যাটর্নি জেনারেলই বলেছেন, তাঁকে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকেরই একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর। অর্থাৎ, সবই হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরব সম্মতির মধ্য দিয়ে। আবার ঋণখেলাপিদের নানাভাবে ছাড়, ব্যাংকমালিকদের নানা সুবিধা দেওয়া—সবই সরকারের একক সিদ্ধান্তে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ‘নয়ছয়’-এর দায় নিতে হবে সরকারকেই। এ পরিস্থিতিতে শক্তিশালী একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে অবশ্যই একটি সাহসী পদক্ষেপ।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যেতে পারে। কেননা, ব্যাংক নিয়ে কমিটি বা কমিশন গঠনের একাধিক উদাহরণ দেশের আছে। অতীতে এ ধরনের কমিশন বা কমিটি গঠনের পটভূমি আলোচনা করলে সাহস নিয়ে আলোচনাটা প্রাসঙ্গিক হবে। দেশে ব্যাংক খাত নিয়ে প্রথম একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। জেনারেল এরশাদ মাত্রই ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেছেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ব্যাংক লুটেরাদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এরপরই ব্রিগেডিয়ার এ কাশেমের নেতৃত্বে অনাদায়ি ঋণ আদায় ও এ-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। এই কমিটির রিপোর্টে যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তাঁরা প্রায় সবাই এরশাদের তৈরি জনদল ও জাতীয় পার্টির অর্থের জোগানদার হয়েছিলেন। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে একটি উদ্দেশ্য থেকেই কমিটি গঠন করে হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যও সফল হয়েছিল। নিজের প্রয়োজনে বা দল গঠনে অর্থের আর অভাব হয়নি।

তবে সত্যিকার অর্থে ব্যাংক খাত নিয়ে দেশের প্রথম ও কার্যকর কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এর আগের বছর বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগে থেকেই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত তফসিলি ও বিশেষায়িত ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বাড়ছিল, ঋণ পরিস্থিতি নিয়েও সঠিক ধারণা ছিল না। এম সাইদুজ্জামান তখন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি গঠন করেন দেশের প্রথম ব্যাংক কমিশন। এর নাম ছিল ‘আ ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট’। এই কমিশন রিপোর্ট দেয় ১৯৮৬ সালে। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে একটি আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে বিশ্বব্যাংক আগ্রহ জানালে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। তবে ১৯৮৭ থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও দুই দফা বন্যার কারণে এই সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দাতাদের সাহায্য নিয়ে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি (এফএসআরপি) চালু হয় এরশাদের পতনের পরে, ১৯৯০ সালে। এর মেয়াদ ছিল ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত।

আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় অনেক ধরনের সংস্কার হাতে নেওয়া হলেও ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি চালু ছিল পুরোদমে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম বছরেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ব্যাংক খাত নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিল ১৯৯৯ সালে। এই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন ছিল পূর্ণাঙ্গ। অনেক কঠোর কথাবার্তাও ছিল। তবে ব্যাংক খাতের দুরবস্থার দায় সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারকে নিতে হয়নি। কেননা, এর আগে ২১ বছর দলটি ক্ষমতাতেই ছিল না। সুতরাং ব্যাংক খাতের দুরবস্থার দায় পড়েছিল আগের সরকারগুলোর ওপরই; বরং সেই ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠনের জন্য এখনো প্রশংসিত হন শাহ এ এম এস কিবরিয়া।

এরপর ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার, আবারও অর্থমন্ত্রী হন এম সাইফুর রহমান। তিনি এসেও আর্থিক খাতের দুরবস্থার সমালোচনা করেন। ২০০২-০৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে এবং এ খাতে পূর্বে সূচিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে অক্ষমতা ও অনীহা প্রদর্শিত হয়েছে।’ এরপর তিনিও একটি ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। তবে সেই কমিটির কার্যপরিধি ছিল সীমিত। মূলত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ সমস্যা পর্যালোচনা করে সমাধান সম্পর্কে সুপারিশ করাটাই ছিল কমিটির কাজ। এই কমিটিও বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল।

সামগ্রিকভাবে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কমিটির রিপোর্টেই দেশে বেহাল ব্যাংক খাতের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। এর আগে খুবই খারাপ অবস্থায় থাকা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ‘ব্যাংক ইন ডিসট্রেস: দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ নামের সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সেই আইএমএফ বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আবার একটি রিপোর্ট তৈরি করে ২০১৯ সালে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে ও ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ঋণগ্রাহকেরা। এখানে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া, নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।’

এ রকম এক অবস্থায় গত এক দশকে ব্যাংক খাতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে একদল চক্রের, সে অবস্থায় একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার কথাই বলা হচ্ছে সব মহল থেকে। ফলে অর্থমন্ত্রীও বাধ্য হচ্ছেন এ নিয়ে কথা বলতে। তবে শেষ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠনের সাহস তাঁর আছে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]