তারপরও তিনি আইনের ঊর্ধ্বে?

বুড়িগঙ্গার তীরে বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিতে বুধবার সকালে দলবল নিয়ে সেখানে যান ঢাকা-১৪ আসনে সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হক। বছিলা, ঢাকা, ৪ মার্চ। ছবি: সাজিদ হোসেন
বুড়িগঙ্গার তীরে বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিতে বুধবার সকালে দলবল নিয়ে সেখানে যান ঢাকা-১৪ আসনে সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হক। বছিলা, ঢাকা, ৪ মার্চ। ছবি: সাজিদ হোসেন

তিনি একজন সাংসদ। সাংসদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। যিনি আইন প্রণয়ন করেন, তিনি আইন ভাঙতে পারেন না। তিনি কেন, কোনো নাগরিকই আইন ভাঙতে পারেন না। ভাঙলে তাঁকে শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু ঢাকা-১৪ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হক আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে নিজের নিয়ন্ত্রণের রেখেছেন। বিআইডব্লিউটিএ সেই জায়গা উদ্ধার করতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখ পড়েছে। কোন ক্ষমতাবলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে বাধা দিলেন। এর জন্য কি তাঁর কোনো শাস্তি হবে?

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা দীর্ঘদিন ধরেই বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। অনেকটা সাপলুডু খেলার মতো। বিআইডব্লিউটিএ অভিযান পরিচালনা করে কোনো এলাকা উদ্ধার করার কিছুদিন পরই সেটি আবার দখল হয়ে যায়। এটাই আমরা গত ২০-২৫ বছর কিংবা তার আগে থেকে দেখে আসছি। সাধারণত যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতা-কর্মী, সাংসদেরা দখলোৎসবে মেতে ওঠেন।

বুড়িগঙ্গায় দখল ও দূষণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন। উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। কিন্তু দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি, তার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে গত মঙ্গল ও বুধবার পেয়েছি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাংসদ আসলামুল হক বুড়িগঙ্গা তীরের ৫ একর জমি দখল করে রেখেছিলেন। মঙ্গলবার বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গা তীরে অভিযান চালিয়ে ৩ একর উদ্ধার করে লাল ফিতা টানিয়ে দিয়েছে। বাকি ২ একর জায়গা পুনরুদ্ধার করতে তারা সকাল ১০টায় অভিযান শুরু করে। প্রথমে লোকজন পাঠিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেন; তাতে ব্যর্থ হয়ে বেলা ১১টার দিকে আসলামুল হক দলবল নিয়ে ‘ঘটনাস্থলে গিয়ে সেই অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দেন’। 

দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের অটলতায় এই দফা আসলামুল হক ব্যর্থ হন। তবে খবরে প্রকাশ, নিজের বাংলোয় ডেকে নিয়ে ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি হুমকি দেন। ম্যাজিস্ট্রেট সেই তথ্য সংবাদমাধ্যমে দিয়েছেন। অচেনা নম্বর থেকে ফোনে হুমকিও পাচ্ছেন। আমরা দেখতে চাই, দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রের একজন বিচারিক কর্মকর্তা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে আসলামুল হকের নিশ্চয়ই জানার কথা যে সেই নির্দেশ তিনি দিতে পারেন না। যারা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে, তারা আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা কাজটি করেছে। সাংসদের দাবি, তিনি পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়েছেন। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ বলেছে, অনাপত্তিপত্রের বাইরের যে জায়গা দখল করে সাংসদ স্থাপনা তৈরি করেছেন, সেখানেই তারা অভিযান চালাচ্ছে।

আসলামুল হকের দাবি সত্য হলেও তিনি বিআইডব্লিউটিএকে অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন না। বিআইডব্লিউটিএর অভিযান তাঁর কাছে বেআইনি বা চুক্তির বরখেলাপ মনে হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু সেসব না করে গায়ের জোর দেখিয়েছেন। সঙ্গে ৭০ থেকে ৮০ জন লোক নিয়ে গেছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএকে অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে তিনি সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন। এটি ফৌজদারি অপরাধ। বিরোধী দল কিংবা আমজনতার কেউ এই কাজ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জেলে পাঠানো হতো। কিন্তু তিনি তো ‘মাননীয়’ সাংসদ। তাঁর জন্য তো একই আইন খাটে না!

এ সময় বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এই সাংসদ বলেছেন, ‘যৌথ জরিপের যে কথা বলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে, তাঁকে সেই কাগজ না দেখালে কাজ বন্ধ থাকবে। তিনি কাজ করতে দেবেন না।’ বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ যে তাঁরা সাংসদের মামাবাড়ির আবদার শোনেননি। অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। সব ক্ষেত্রেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এ রকম সাহসী পদক্ষেপ চাই।

তবে শুধু অভিযান চালিয়ে বিআইডব্লিউটিএ নিজের দায় এড়াতে পারে না; নদীর তীরের জায়গা কীভাবে সাংসদকে পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির জন্য ইজারা দিলেন? নদী রক্ষা করতে হলে তার তীরও রক্ষা করতে হবে। অবিলম্বে সব ইজারা বাতিল করতে হবে, যাতে কেউ এসে বলতে না পারে, ‘আমার হাতে অনাপত্তিপত্র আছে।’ এ রকম অনাপত্তিপত্রের দোহাই দিয়ে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ এখনই বন্ধ হোক। অনেক দেশে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নদীর ক্ষতি হওয়ামাত্রই সেখানে সরকারিভাবে মামলা হয়ে যায়। আমাদের দেশে সে রকম একটি আইন হওয়ার জরুরি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সাংসদ আসলামুল হকের দেওয়া হলফনামায় দেখা গেছে, তাঁর অস্থাবর সম্পদ গত ১০ বছরে ৪৫ গুণ এবং তাঁর স্ত্রীর অন্তত ৪ গুণ বেড়েছে । 

আসলামুল হক ব্যবসা করে, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট তৈরি করে যত খুশি টাকা উপার্জন করুন না কেন, নদীতে হাত দিতে পারেন না। আইনপ্রণেতা হিসেবে আইনের বিষয়ে কতটুকু সজাগ, সেই প্রশ্ন থাকলেও ধনসম্পদ বাড়ানোর জ্ঞান বেশ টনটনে। আইনপ্রণেতারা জনগণের নামে সাংসদ হয়েও জনগণের কথা ভাবেন বলে মনে হয় না।

প্রভাবশালীরা গত ৪৯ বছরে বুড়িগঙ্গা দখল করতে করতে একেবারে মুমূর্ষু করে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতই বলেন বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে, তাঁর সাংসদেরা, দলের লোকেরা এটি দখল করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

কয়েক দিন আগে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সংসদ এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। তবে সেই ব্যবসায়ীদের মধ্যেও রকমফের আছে। সব ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার জন্য রাজনীতি করেন না। কেউ কেউ নিজের টাকা খরচ করেও রাজনীতি করেন। রাজনীতিতে আসার আগে ও পরে সাংসদ আসলামুল হকের সম্পদের হিসাব নিলে পরিষ্কার হবে তিনি কোন শ্রেণির ব্যবসায়ী। আসলামুল হকেরা রাজনীতিকে নিয়েছেন নিজের ভাগ্য গড়ার অপূর্ব সুযোগ হিসেবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সুযোগসন্ধানীদের দলে ঠাঁই নেই। দলে ঠাঁই না থাকুক, সংসদে তো আছে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।