মাশরাফি কেন অধিনায়কত্ব ছাড়লেন?

মাশরাফি বিন মুর্তজা।
মাশরাফি বিন মুর্তজা।

আমি কি চোর? চুরি করি মাঠে? সাম্প্রতিক খেলার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন করায় চলমান জিম্বাবুয়ে সিরিজের এক দিনের ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা কিছুটা বিরক্ত হয়েই এসব কথা বলেন।

মাশরাফি শুধু ক্রিকেটেরই নন, ক্রীড়াঙ্গনের মহানায়ক। নায়কেরা সময়ে সময়ে আর্বিভূত হন। তবে এঁদের মধ্যে মহানায়ক হতে পারেন কমই। মাশরাফি আমাদের সেই মহানায়কদের একজন, যাঁরা আমাদের পরিচিত করিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটে। অনেকেই মাশরাফিকে নিয়ে জানতে চান। কিছুদিন আগে এক অস্ট্রেলীয় বন্ধু আশরাফুলের কথা বললেন। জানতে চাইলেন, এখনো ক্রিকেট খেলে কি না। বাঁ হাটুতে বারবার অপারেশন করানো পেসারের খবর কী? অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোককে বললাম, আমাদের এখন তামিম আছে, মুশফিক, সাকিব, মোস্তাফিজ আছে। কিন্তু ওই লোকের মাথায় আশরাফুল ও মাশরাফিই গেঁথে আছেন।

আমাদের এই মহানায়ক সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে মেজাজ হারিয়েছিলেন। প্রশ্নটা ছিল নিজের বর্তমান পারফরম্যান্স নিয়ে মাশরাফি লজ্জিত কি না? সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও দেখে মনে হলো মাশারাফি নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। প্রশ্নটা হয়তো খুব বেশি সমীচীন হয়নি। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্নবাণ খেলোয়াড়দের নৈতিক বল দিয়ে সামলাতে হয়। নৈতিক জায়গায় নড়বড়ে হলে মেজাজ হারানোর শঙ্কা থাকে।

অনেক খেলোয়াড়ের জীবনেই ফর্মহীনতা আসে। কেউ টানা রান পাচ্ছে না। উইকেট পাচ্ছে না। ফুটবলে গোল পাচ্ছে না। সর্বশেষ এল ক্লাসিকোতে লিওনেল মেসি গোল পাননি। টানা পাঁচটি এল ক্লাসিকোতেই মেসির গোল নেই। এবারের এল ক্লাসিকোর পর কথা উঠেছে, মেসি আর পারছেন না। তাঁর অবসরের সময় চলে এসেছে। ভালো সুযোগ পেয়েও গোল করতে পারেননি। সমালোচনার বিপরীতে উত্তেজিত হয়ে মেসি পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কয়েক বছর ধরে অসাধারণ খেলতে থাকা লিভারপুলের মোহামেদ সালাহ মাঝে কিছুদিন গোল পাননি। সালাহকে নিয়েও সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। সালাহ স্বার্থপর, একাই গোল করতে চান ইত্যাদি। সালাহর কারণে সাদিও মানে ও রবার্তো ফিরমিনো গোলবঞ্চিত হন অনেক সময়। সমালোচনা থাকবেই। কিন্তু মেজাজ হারালে চলবে না। সমালোচনার জবাব মাঠে দিতে হয়।

কিন্তু কিছু সময় ধরে মাশরাফির ফর্ম নিয়ে একটু বেশিই সমালোচনা হচ্ছে। মাশরাফি সাংসদ হওয়ার পরও খেলছেন। মাশরাফির বন্ধু ও সতীর্থ মোহাম্মদ আশরাফুলও এমনটিই মনে করছেন। ওই দিনের সংবাদ সম্মেলনের পর একটি টকশোতে আশরাফুল বলেন, ‘এমপি হওয়ায় সমালোচনা বেশি হচ্ছে। এমপি না হলে এটা হতো না। অনেকেই মনে করছে, একই সঙ্গে দুটো কাজ কীভাবে সামলাবে।’

গত বিশ্বকাপে একটি বল আটকাতে না পারায় নিউজিল্যান্ডের সাবেক পেসার ও ধারাভাষ্যকার সাইমন ডৌল রসিকতা করে বলেন, সাংসদ বল আটকাতে পারলেন না। সমালোচনা বিভিন্নভাবেই আসবে। রাজনীতি করা কোনো সমস্যা নয়। এর আগেও অনেক দেশে অনেক খেলোয়াড় সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীই হয়ে গেলেন পাকিস্তানের। অবশ্য ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। সমালোচকেরা বলে থাকেন, দেশটির সেনাবাহিনীর সমর্থন ও হস্তক্ষেপে ইমরানের দল বিজয়ী হয়েছে। পাকিস্তানের ওই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়নি।

সম্ভবত মাশরাফিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি অধিনায়ক থাকা অবস্থায়ই সাংসদ হয়ে রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছেন। এই নির্বাচন নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। এসব জানেন বলেই কি এক ধরনের নৈতিক চাপে আছেন মাশরাফি? চাপের কারণে মাশরাফি মেজাজ হারিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আবেগী কথা বলে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি অতীব সত্য কথা বলেছেন। মাশরাফির কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে নানাবিধ দুর্নীতি ও লুটপাট হচ্ছে। কোনো মন্ত্রী–এমপিকে কি কেউ কোনো দিন প্রশ্ন করেছেন, বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী হতে লজ্জা করছে কি না? কোনো ঘুষখোর আমলাকে কি কেউ কোনো দিন প্রশ্ন করছে? তবে মাশরাফিকে এই প্রশ্ন কেন?

মাশরাফিকে এই প্রশ্নের কারণ, তিনি আমাদের এক লড়াকু চরিত্র, যে বারবার ফিরে আসে। এমন অবস্থা থেকে তিনি ফিরে এসেছেন বা এখনো ক্রিকেট খেলছেন, তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর একাগ্রতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খেলার মাঠে মাশরাফির সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

সবারই কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকে। খেলোয়াড় হিসেবে মাশরাফির কিছু লক্ষ্য ছিল। সব না হলেও বেশির ভাগই পূরণ হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়েছেন। বিশ্বকাপে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর লক্ষ্য কী হতে পারে? রাজনীতিতে তিনি নবীন। এখনই তাঁর পক্ষে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। তবে এমন হতে পারে, খেলা থেকে অবসর নিয়ে তিনি ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেলেন। এমনটা হওয়া অসম্ভব নয়। কী হবেন না হবেন এসব বিষয়ে মাশরাফি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। তেমনি কবে অবসরে যাবেন, খেলার মাঠে পারফরম্যান্স নিয়ে লজ্জিত হবেন কি না, এসব নিয়ে মাশরাফিকেই ভাবতে দিন।

মাশরাফি প্রশ্ন করেছেন, আমি কি চোর? এই প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে কি মাশরাফি দায়মুক্তি চাইছেন? কারণ, তাঁর সাংসদ হওয়ার নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তাঁর নিজের আসনেও। মাশরাফি তাঁর আসনের একটি কেন্দ্রে একাই সব ভোট পেয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি তথ্য বেশ চাউর হয়েছিল। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সবাই সেই কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছে।

মাশরাফি ক্রিকেটে কোনো অন্যায় করেননি। ক্রিকেটে আজকাল এতটাই কড়া নজরদারি করা হয় যে চুন থেকে পান খসলেই শাস্তি নির্ঘাত। কোনো অপরাধ না করেও কেবল জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য চেপে যাওয়ায় সাজা ভোগ করছেন সাকিব আল হাসান।

ক্রিকেটের কড়া নিয়মকানুন মাশরাফি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছেন। কিন্তু যেনতেন নির্বাচনে সাংসদ হওয়ার লোভ সংযম করতে পারেননি। নির্বাচনের পরপরই একটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোটপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, এটি কেন্দ্রের লোকজন ও নির্বাচন কমিশনের দেখার বিষয়। নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেলেও হয়তো মাশরাফি মনোযাতনায় ভুগছেন। তাই ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্নও তাঁকে নির্বাচনের অনিয়মের কথা মনে করিয়ে দেয়। অবচেতন জায়গা থেকে তিনি মনে করেন, তাঁকে নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন করা হচ্ছে। রাজনীতিই কি তাঁর মানসিক অস্থিরতার কারণ? বিতর্কিত রাজনীতির নির্বাচনই কি তাঁর নায়কোচিত জীবনের একমাত্র কলঙ্ক হয়ে থেকে যাবে?

ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক