আমরা প্রস্তুত কতটা?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে

অক্সফোর্ড স্ট্রিট লন্ডনের অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। এর চারপাশে খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এর বুকজুড়ে নামী বিপণিবিতান, আশপাশে শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এখানে ২ মার্চ রাতে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক এক ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। এর বিবরণ দিয়েছেন ঘটনার শিকার জোনাথন মক নামের সিঙ্গাপুরের এক তরুণ। দুই বছর ধরে তিনি পড়াশোনা করছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে। কাছের অক্সফোর্ড স্ট্রিট থেকে ফেরার পথে সে রাতে পেভমেন্টে তাঁকে উদ্দেশ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন কয়েকজন যুবক। তিনি করোনা শব্দটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তাঁর ওপর চড়াও হন তাঁরা। কিল–ঘুষিতে তাঁর নাক-চোখ রক্তাক্ত করে অকথ্য গালাগাল করতে করতে চলে যান তাঁরা।

এরও সপ্তাহ দুই আগে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি সাব ওয়েতে জিরাপ্রাপাসুকে নামের এক থাই তরুণীকে করোনা আক্রান্ত চীনা ভেবে যেভাবে উত্ত্যক্ত করা হয়, এটিও ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। কিন্তু এরপরও এমন হেনস্তার বহু ঘটনা ঘটছে উন্নত বিশ্বে।

২.
বসে বসে এসব পড়ি আর ভাবি, করোনা যদি হতো এ দেশে, কী অবস্থা হতো ইউরোপ–আমেরিকার শহরগুলোসহ পৃথিবীর কয়েক হাজার শহরে থাকা বাংলাদেশের মানুষের! মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, নিম্ন আয়ের চাকুরে, অবৈধ অভিবাসী, আর দুর্বল দেশের মানুষ হিসেবে এমনিতেই নানা হয়রানির শিকার হন তঁারা। করোনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে না জানি আরও কীভাবে অপদস্থ হতেন তাঁরা সেখানে! না জানি বিদেশে পড়াশোনা-চাকরি-ব্যবসা-অবকাশে যাওয়া বা যেতে চাওয়া মানুষ পড়ত কী বাড়তি বিড়ম্বনায়!

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শিকার দেশগুলোতে ব্যবসা–বাণিজ্য, উৎপাদন, চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। সীমান্ত বন্ধ হচ্ছে, যোগাযোগ সীমাবদ্ধ হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানি-বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে, শেয়ারবাজার ধসে পড়ছে। করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত চীন, ইরান, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় অনেক দুর্বল বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটলে কী অবস্থা হবে বাংলাদেশের মানুষের?

অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু দেশে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সুপার মার্কেট খালি করে পণ্য জমিয়ে রাখছে মানুষ, ফ্রান্সে মাস্ক চুরি হচ্ছে, কোরিয়ায় হ্যান্ড সেনিটাইজার ছিনতাই হয়েছে। আইনের শাসন বলতে কিছু নেই আমদের এ দেশে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটলে কী অবস্থা করবে অস্ত্র, ক্ষমতা আর বিপুল বিত্ত হাতে থাকা লোকেরা, কী করুণ পরিণতি হবে বাকিদের?

ভাবি, না জানাই ভালো, তাই হয়তো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত না হওয়াই ভালো। চীনের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্ত মিয়ানমারের, হাজার হাজার চীনা মানুষের বাস মিয়ানমারে। মিয়ানমারে নাকি আজও কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। নিউজিল্যান্ড থেকে চিলি—পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে করোনা চলে গেছে। যায়নি মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পূর্ব ইউরোপ আর আফ্রিকার দেশগুলোতে। এসব দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিয়ে বিতর্ক আছে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির। ভাবি, থাকুক এসব, করোনাভাইরাসের খবর চেপে রাখলে সমস্যা কী। খবর জানিয়েই–বা কী লাভ।

করোনাভাইরাসের কোনো মোক্ষম চিকিৎসা নেই। এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে লাগবে কমপক্ষে চার মাস, অ্যান্টিবডি তৈরি করতে লাগবে দেড় বছর, প্রচলিত কোনো টিকা বা ওষুধ (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা এইচআইভির ক্ষেত্রে) আন্দাজে ব্যবহারে কুফল থাকতে পারে আরও বেশি। এ জন্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রত্যেককে হাসপাতালে বা নিজে নিজে ঘরে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়, প্রয়োজনে আর্মি-পুলিশ দিয়ে পুরো শহরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হয়, স্কুল–কলেজ বন্ধ করে রাখতে হয়, বাসায় বসে অফিসের কাজ করার ব্যবস্থা করতে হয়।

আমি ভাবি, রাস্তায় কফ আর থুতু না ফেলার দায়িত্ববোধ নেই এ দেশে। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে নিজে নিজে দু-তিন সপ্তাহ কারও সংস্পর্শে না আসার দায়িত্ববোধ থাকবে আমাদের কতজনের? সামর্থ্যই বা আছে কতগুলো পরিবারের? একটা শহর ঘিরে ফেললে কী অবস্থা হবে দেশের? সেই ঘিরে থাকা মানবেন কি না শহরের ভিআইপিরা? বিচ্ছিন্ন ঘর, পাড়া বা শহরে খাদ্য, চিকিত্সা, নিরাপত্তা জোগাবে কে? স্কুল বন্ধ হলে কোথায় সময় কাটাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা? বাসায় বসে অফিস করার কোনো ব্যবস্থা আদৌ কি আছে এ দেশে? কীভাবে হবে করোনাভাইরাসের তথ্য ব্যবস্থাপনা?

তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এ দেশে করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হয়েছে কি না, তা–ই বা জানব আমরা কীভাবে? বায়ুদূষণের এ দেশে সারা বছর লেগে থাকে সর্দি-কাশি, জ্বরভাব। কীভাবে আমরা বুঝব করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভিন্ন কিছু এসব থেকে?

তাহলে তো বেশি ভালো বোধ হয় না জেনেই থাকি আমরা। সুনামি বা বিমান দুর্ঘটনায় যখন কিছুই করার নেই, তখন স্রষ্টার দয়ার ওপর ছেড়ে দেয় মানুষ নিজেদের। এটা করা ছাড়া আর কি কিছু করার আছে এ দেশে?

৩.
আসলে আছে। আসলে জেনে–বুঝে চুপচাপ থাকার ক্ষতি অনেক বেশি। করোনার তথ্য গোপন রাখা সম্ভবও হয় না একপর্যায়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য চেপে রেখেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ছোট্ট একটি খ্রিষ্ট ধর্মীয় কাল্ট। এর পরিণতিতে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে। প্রথম থেকেই সতর্ক ইংল্যান্ডে এটি ছড়িয়েছে অনেক কম মাত্রায়। আসলে সততা, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির ক্ষতির সম্ভাবনা কম। জ্ঞান আর তথ্যেই মুক্তি।

কী করতে পারি আমরা তাহলে? আমি এর উত্তর জানি না। কিন্তু এর উত্তর জানতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র বলছে করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। চীন বলেছে একই কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের মতো অনুন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশগুলো নিয়ে। জানতে চাই আমাদের উদ্বেগ নেই কেন? আমাদের মন্ত্রীরা বলছেন প্রস্তুত আছি আমরা। জানতে চাই, কী প্রস্তুতি আছে আমাদের, কীভাবে প্রস্তুত আছি?

করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলো কি না, বুঝব কীভাবে, কোথায় গেলে? আক্রান্ত হলে রোগীদের বিচ্ছিন্ন রাখার সুব্যবস্থা আছে কোন হাসপাতালে? যাঁরা বাসায় বিচ্ছিন্ন থাকবেন, তাঁদের চিকিৎসার কী হবে? ছাত্রাবাস, মেস, হাসপাতাল, বস্তির মতো যেসব জায়গায় একসঙ্গে থাকে বহু মানুষ, সেখানে কী কী বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তার ফলে বাণিজ্য আর উৎপাদন ব্যাহত হলে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য পাব কোথায়? খেটে খাওয়া মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তার পরিবার খাবে কী? বৃদ্ধ মানুষের বাড়তি ঝুঁকি মোকাবিলার কী ব্যবস্থা আছে আমাদের? করোনাভাইরাস নিয়ে সার্বিক কর্মপরিকল্পনা কী সরকারের? এসব আমরা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই। করোনাভাইরাস সম্পর্কে অতি জরুরি তথ্যের প্রচার চাই মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কলেজ, এনজিও, মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

সরকারের, বেসরকারি খাতের, সাধারণ মানুষের আরও কী কী করার আছে, তা–ও জানতে চাই। দেখতে চাই সরকার ঘনঘন বসছে বিষয়টি নিয়ে। প্রয়োজনে সাহায্য নিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশি-বিদেশিদের। মানুষকে জানাচ্ছে প্রকৃত অবস্থা প্রতিদিন। বুঝতে চাই বাংলাদেশের মতো অতি জনবহুল দেশে করোনার ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আসলেই উদ্বিগ্ন, সতর্ক ও কর্তব্যনিষ্ঠ রয়েছে সরকার।

পেঁয়াজের দাম বাড়লে, এডিস মশা বেশি ডিম পাড়লে, ঈদের চাঁদ মেঘে আচ্ছাদিত থাকলে হতোদ্যম হয়ে পড়ে আমাদের সরকার। আর করোনাভাইরাস সামলাতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে মহাকাশে অভিযান চালানো দেশগুলো, সেখানে বাংলাদেশে প্রস্তুত আছি, ভয় নেই—শুধু এ ধরনের কথা বলে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যাবে!

৪.
আমরা জানি বিপদ বেশি হলে বিদেশে গিয়ে আরাম–আয়েশে থাকার সামর্থ্য ও মানসিকতা আছে আমাদের কিছু মানুষের। অতীতে এ কাণ্ড হয়েছে দেশে। কিন্তু তাঁদের জানা উচিত, এবার এটি করা সহজ হবে না। একবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে অন্য কোথাও পালানো মুশকিল হবে যে কারও।

শোষক, লুটেরা, খুনি—সবাই নিরাপদে বিদেশে যেতে পারে। কিন্তু; করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশের মানুষেরা তা পারে না।

এটা ভেবেও কি একটু সাবধান হবেন এ দেশের কর্তাব্যক্তিরা?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক