পাপিয়া-কাণ্ড নারী দিবসে কতটা আলোচ্য হবে?

শামীমা নূর পাপিয়া।
শামীমা নূর পাপিয়া।

আলোচনাটি নাজুক। এ রকম কোনো আলোচনায় নামার কথা মনে আসেনি। তবে এক ছাত্রের বিশেষ অনুরোধে ঢেঁকিটি গিলতে হচ্ছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সপ্তায় চারটি ক্লাস নিতে হয়েছে ‘সামাজিক সমস্যা, অপরাধ, বিচ্যুতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ে। কাকতালীয়ভাবে আগের ক্লাসগুলো ছিল ‘লৈঙ্গিক সামাজিকীকরণ’ বিষয়ে। এদিকে নারী দিবসের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্রছাত্রীরা সম্ভবত প্রস্তুতির অংশ বা হকদার। এদিকে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করে চলেছি সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে নজর রেখে পাঠ্যসূচি বুঝতে চেষ্টা করার জন্য। সুযোগ বুঝে একজন ছাত্র আমাকেই পরীক্ষায় ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ আবদার রেখেছেন সাম্প্রতিক পাপিয়া-কাণ্ডকে উদাহরণ ধরে একটি সহজ সমাজপাঠ্যমূলক লেখা যেন লিখি।

‘পাপিয়া-কাণ্ড নারী দিবসে কতটা আলোচ্য হবে?’ প্রশ্নটিও তাঁরই তৈরি করে দেওয়া। নারী দিবস আসছে। অনেক আলোচনাই হবে। কী কী আলোচনা হতে পারে, সেসব বিষয়ে তাঁর একটি সাধারণ ধারণা আছে। তিনি মতামতও দিয়েছেন যে সেই একই আলোচনা শুনে আসছেন বাল্যকাল থেকেই। প্রতিবছরই আগ্রহ নিয়ে পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেন নতুন কোনো সাম্প্রতিক বিষয় আলোচনায় এসেছে কি না, যা থেকে জেন্ডার-সংবেদী কোনো নতুন ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু হতাশার কথা এই যে সাম্প্রতিক সমস্যার চুলচেরা বিশ্লেষণের চেয়ে বিমূর্ত তাত্ত্বিক আলোচনাতেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে। তাই প্রশ্ন রেখেছেন পাপিয়া-কাণ্ডটি নারী দিবসের আলোচনায় আসার সম্ভাবনা কতটুকু? যদি আলোচনায় না আসার মতো অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করা হয়, তবে ‘আলোচিতব্য নয়’ ভাবার সম্ভাব্য কারণ কী কী হতে পারে?

সত্য বলতে দ্বিধা নেই, প্রস্তাবনাটি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে হকচকিত হয়েছিলাম। একসময় মনে হলো প্রসঙ্গটি তো আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ—এক, খবরে বেরিয়েছে পাপিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন ১ হাজার ৭০০ জন ‘সুন্দরী নারী’। তাঁদের নানাভাবে ফুসলিয়ে বা ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে আসা হয়েছিল। নির্দ্বিধায় ধরে নেওয়া যায়, অন্তত ১ হাজার ৭০০ জন নারীর কাছে নিরাপত্তার শিক্ষাটি ঠিকমতো পৌঁছায়নি। এবার পরিবারে ফিরি। তাঁরা এসেছেন ১ হাজার ৭০০টি পরিবার থেকে। অর্থাৎ, ১হাজার ৭০০টি পরিবার নারীর রক্ষাকবচ হতে পারার সামর্থ্য অর্জন করেনি। ফিরুন সমাজে। ১ হাজার ৭০০টি পরিবার হয়তো কয়েক শ ভিন্ন ভিন্ন এলাকার। অর্থাৎ কয়েক শ এলাকাই নারী শিকারের ক্ষেত্র হিসেবে নারী শিকারিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে আছে। পাপিয়াই জানিয়েছেন, কপালের দোষে তাঁকে ধরা পড়তে হয়েছে। কিন্তু এই ব্যবসায় শত শত নারী আছেন। পাপিয়ার নেটওয়ার্কও যে নানা এলাকায় বিস্তৃত, সে কথা পত্রিকাগুলোতেই এসেছে। সে হিসাবে কয়েক লাখ না হলেও কয়েক হাজার নারী যৌন দাসত্বের বলি হয়ে আছেন। যেহেতু এই পেশা অত্যন্ত গোপনীয় এবং আড়ালের ও অন্ধকার জগতের—অনুমানও করা কঠিন কার কন্যা বা মা বা বোন কখন পাপিয়াদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।

সামাজিক মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তির্যক মন্তব্যগুলো যেমন, হালকা রগড়গুলো পাঠেও তেমনই চিন্তিত হতে হয়। কারণ, সেগুলো গড়পড়তা সামাজিক মনোভাবের প্রতিচ্ছবি। পাপিয়ার বহরে কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও রয়েছেন। অসংখ্য নারীবিদ্বেষী মন্তব্যে দেখা গেল অনেকে লিখেছেন প্রয়োজনে চিরকুমার থাকুন, কিন্তু ‘কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পড়ুয়া ছাত্রীদের বিয়েশাদি করার চিন্তা বাদ দিন’। বেশ বড় একদলকে দেখা গেল এমনই জেন্ডার-সংবেদনহীন যে তারা ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ধারণাটিকে বিদ্রূপ করছে। ব্যঙ্গ করতে ছাড়ছে না জেন্ডার-সমতা, বৈষম্য মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, শারীরবৃত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে। তাদের চিন্তা জাগতিক দৈন্যকে আমলে নেওয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই বলে সটকে পড়া যায় বটে, কিন্তু সমস্যার তিমির কাটানোর রাস্তা তাতে আরও বন্ধ হয়ে আসতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য মন্তব্যে দেখা গেল আমার ছাত্রটির দুশ্চিন্তার মতো একই ধরনের ভাবনার অনুরণন। অনেকেই জানতে চাইলেন অন্যত্র এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে উচ্চকিত নারীরা এসব বিষয়ে সচরাচর চুপচাপ থাকেন কেন? প্রশ্ন এসেছে, অপরাধীরা ক্ষমতাকেন্দ্রের অত্যন্ত কাছের হওয়ায় ভয়ে বলেন না, নাকি নারীর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে চলতে থাকা অপরাধজগৎকে তাঁরা অপরাধ মনে করেন না?

এ কথা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না যে পাপিয়ার মতো অন্য সব সরদারনীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বড় অংশ সরদারনী হয়ে উঠতে চাইবে। কারণ, কাঁচা টাকার হাতছানি। চোখের পলকে সরদারনীদের ধনী থেকে মহাধনী হতে দেখার অভিজ্ঞতা এবং তা হতে তৈরি হওয়া লোভ। নতুন সরদারনী বাড়লে দেশের ভেতরে-বাইরে দুই জায়গাতেই নারী পাচার বাড়ে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ কার্যালয় বিশ্বব্যাপী গবেষণার আলোকে এক ভয়াবহ তথ্য উপস্থাপন করেছে। তথ্যমতে নারী পাচারের পেশায় ও নেতৃত্বদানে নারীর অংশগ্রহণ বছর বছর বাড়ছে। প্রতিবেদনটিতে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে যে যেখানে বিশ্বের সব অপরাধে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৮ শতাংশ, সেখানে নারী পাচারের মতো অপরাধে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিলের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের শিরোনামই ছিল ‘পতিতাবৃত্তির জন্য নারী দ্বারা নারী পাচার খারাপ থেকে খারাপতর দিকে যাচ্ছে’ (উইমেন সেক্স-ট্রাফিকিং আদার উইমেন দ্য প্রবলেম ইজ গেটিং ওয়র্স’)।

ল্যেই আইভেন্স নারী পাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন শীর্ষ কর্মী। তাঁর ‘পপি প্রজেক্ট’ এ-সংক্রান্ত গবেষণার জন্যও বিখ্যাত। আইভেন্স জানালেন, নারী পাচারকারীরা পুরুষ পাচারকারীদের তুলনায় অনেক বেশি নির্দয়, নৃশংস ও হিংস্র। পাপিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা নারীরা পুলিশের কাছে তাঁদের প্রতি নির্যাতনের যেসব বর্ণনা দিচ্ছেন, সেগুলো ল্যেই আইভেন্সের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গত বছরের মে মাসে স্প্রিঙ্গার প্রকাশনীর বিখ্যাত জার্নাল ক্রাইম, ল অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জে মিরিয়াম ইকম্যান ও এডওয়ার্ড ক্লিম্যান্স নামের দুজন গবেষক ‘যৌন নির্যাতন ও মানব পাচারে নিয়োজিত নারী অপরাধী’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন যে অপরাধবিজ্ঞান এবং নারীবাদী আলোচনার অন্যতম দুর্বল একটি দিক এই যে নারীদের দ্বারা সংঘটিত যৌন অপরাধের হার, মাত্রা ও পরিণাম ফলের দিকে যথাযথ প্রয়োজনীয় নজরটুকু দেওয়া হয়নি। তাঁরা আরও ভয়াবহ তথ্য দেন যে মধ্য ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ায় নারীদের পাচার ও যৌনকর্মে বাধ্যকারীদের শতকরা ৬৮ ভাগই নারী। এই সংখ্যা জাতিসংঘের উল্লেখ করা বৈশ্বিক গড় শতকরা ৩৮ ভাগের প্রায় দ্বিগুণ।

গবেষকেরা দুজনই নারীবাদী হয়েও র‍্যাডিক্যাল নারীবাদের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ মনে করে যে পতিতাবৃত্তি অত্যাবশ্যকীয়ভাবেই ‘নারীর প্রতি পুরুষের এক প্রকারের সহিংসতা’ এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই যদি সঠিক হবে, তাহলে ‘পতিতা’র বদলে ‘যৌনকর্মী’ (সেক্স ওয়ার্কার) ; যৌনকর্মীর কাজকে ‘যৌনকর্ম’ (সেক্স ওয়ার্ক) এবং ‘যৌনসেবায়/শিল্পে কর্মজীবী নারী’ (ওয়ার্কিং উইমেন ইন দ্য সেক্স সার্ভিস/ইন্ডাস্ট্রি) ইত্যাদি ধারণাগুলোকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। ‘পুরুষের সহিংসতাই’ যদি হবে, তাহলে এই পেশার নারীরা কেন একে ‘ওয়ার্ক’ বা ‘কাজ’ বলেন, সহিংসতা বলেন না। সে যা-ই হোক, এই তাত্ত্বিক বিতর্ক এ লেখার ক্ষুদ্র পরিসরে ধারণ করা সম্ভবও নয়। প্রসঙ্গটি কোনো পক্ষ অবলম্বনের জন্যও নয়। উদ্দেশ্য শুধুই এটি বলা যে নারী দ্বারা নারীর প্রতি যে যৌন সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে, সেটি এড়িয়ে যাওয়ার বা আমলে না নেওয়ার সুযোগ কমে আসছে। এই আলাপ নারী দিবসের ভাবনার গণ্ডিতেও জায়গা পাওয়ার দাবিদার।

পত্রিকায় এসেছে, পাপিয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো অনুশোচনার চিহ্ন দেখা যায়নি। প্রথম দিকে সাংবাদিক, পুলিশসহ সবাইকে বরং হুমকিই দিয়েছিল যে তাঁর হাত অনেক লম্বা। ক্ষমতাধরদের সঙ্গে তাঁর লেনদেন, ওঠাবসা। ক্ষমতাধর হওয়ার এক উদগ্র কামনা দেখা গেছে পাপিয়ার মধ্যে। এমপি হওয়ার জন্য নাকি কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছেন। সংসদ সদস্যরাই দেশের আইনপ্রণেতা। পাপিয়ার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আইন তৈরি করা ছিল না; বরং তা ছিল আইন ভাঙার সম্ভাব্য সব তরিকা ব্যবহার করে নিজের অপরাধজগৎকে সুসংহত করার জন্য। এসব কর্মকাণ্ড স্পষ্টই অপরাধ। যেসব হতভাগা নারীকে তিনি যৌনকর্মে বাধ্য করতেন, তাঁদের প্রতি বর্বর নির্যাতন তো অপরাধ বটেই, সংশ্লিষ্ট অন্য সব কর্মকাণ্ডও আগাগোড়াই অপরাধসর্বস্ব। তবু তাঁর দাবি, তিনি নির্দোষ। অন্যরাই তাঁকে অমুক-তমুক বানিয়েছে বলে বয়ান হাজির করছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্কের অপরাধ তাঁর নিজেরই দায়। ‘অন্যরা বানিয়েছে’ দোষ চাপানোর মধ্যে ‘নারীর অধস্তনতা’ কার্ডটি খেলার প্রচ্ছন্ন চালাকি আছে। ‘নারী ভিকটিম’ কার্ড খেলে নারী হিসেবে সহানুভূতি পাওয়ার বা খানিকটা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাও থাকতে পারে। ‘নারী পরিস্থিতির শিকার’ ধরনের সহানুভূতিকামী বয়ান অপরাধী নারীর দুরাচার মাত্র। এ ধরনের আচরণ নারী-অগ্রগতির চাকাকেই বরং পেছনে টেনে ধরে।

জাতিসংঘ নারী সংস্থা (ইউএন উইমেন) ২০২০ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে ‘আই অ্যাম জেনারেশন ইকুয়ালিটি’ বা ‘আমি সমতার প্রজন্ম’। নতুন প্রজন্মের কিশোরী-তরুণীদের জীবনমানে সমতা আনয়ন এই প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য। তাদের নিরাপদ ও নিরাপত্তাপূর্ণ যৌনজীবনের অধিকার এবং প্রজনন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করাও এই প্রতিপাদ্যের একটি লক্ষ্য। পাপিয়াদের যৌনাপরাধ-নেটওয়ার্কের মূল শিকার কিশোরী-তরুণীরাই। একই লিঙ্গের হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কিশোরী-তরুণীরা পুরুষদের চেয়ে নারীদের অনেক বেশি সহজে বিশ্বাস করে। কিশোরী-তরুণীরা তাই প্রতারক নারীদের সহজে চিনতে পারে না। যৌনাপরাধ চক্রের নারীরাই তাই কিশোরী-তরুণীদের শিকার বানানোর ক্ষেত্রে বড়সড় হুমকি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে এবারের নারী দিবস পুরুষ যৌনাপরাধ চক্রের পাশাপাশি নারী যৌনাপরাধ চক্রের বিরুদ্ধেও সমানভাবে উচ্চকিত হওয়ার সূচনাকেন্দ্র হয়ে উঠবে।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়